logo
আপডেট : ৭ অক্টোবর, ২০২৪ ০৯:৪৯
‘যৌক্তিক সময়’ কতদিন
রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বেড়াজালে আগামী নির্বাচন
নিখিল মানখিন

‘যৌক্তিক সময়’ কতদিন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সংঘঠিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ফিরিয়ে এনে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর- এমন একগুচ্ছ দাবি ছিল রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জনসাধারণের। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের দাবি করে আসছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল।

সম্প্রতি বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সেনা প্রধানের বক্তব্যে ‘দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন’ তথ্যটি বেরিয়ে এলেও রোডম্যাপ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের বিদেশি অপর এক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘সরকারের মেয়াদ কতদিন তা সরকারই জানাবে।’ এতে করে নির্বাচন নিয়ে আরও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। এরপরই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে বক্তব্য দিতে থাকেন। এর প্রেক্ষিতে গত শনিবার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ওই বৈঠকের পরও নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপের ঘোষণা আসেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো উভয় পক্ষই সংস্কার শেষে ‘যৌক্তিক সময়ে’ নির্বাচনের কথা বলছে। এই ‘যৌক্তিক সময়’ কতদিন, কত মাস না-কি বছর তা জানার অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন সবাই।

পেছনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা কারও নেই। এক ধরনের অনিশ্চতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো মধ্য থেকে নির্বাচনি রোডম্যাপের দাবি ওঠে। সাধারণ মানুষও অপেক্ষায় কবে, কখন অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন? বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রায় প্রতিদিনই রোডম্যাপের দাবি উত্থাপিত হয় বিএনপি নেতাদের মুখে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে না পারা আওয়ামী লীগ নেতারাও সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আগামী নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণেও নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল না। বিভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে নির্বাচনি রোডম্যাপের বিষয়ে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ ও ‘জনগণ সিদ্ধান্ত দেবে’ এমন মন্তব্য করেছেন। সর্বশেষ ‘সরকারের মেয়াদ কতদিন তা সরকারই জানাবে’ বলে ইতোমধ্যে মন্তব্য করে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দফা সংলাপেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়ীত্ব এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমর্থনের অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। সেনা প্রধানের এমন বক্তব্যেও নির্বাচনি রোডম্যাপ দাবি থেকে সরে যায়নি রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনি রোডমাপ ও সংস্কার নিয়ে আলোচনায় উপদেষ্টা পরিষদ থেকে শুরু করে সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনি রোডম্যাপ ও সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে কথা বলার সময় সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত রাখছেন। তাই ‘যৌক্তিক সময়’ শব্দ দুটি বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে।

যৌক্তিক সময় কতদিন
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর রমনা এলাকাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউশন (আইইবি) মিলনায়তনে এক শিক্ষক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশকে সঠিক দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছি। আমরা তাদেরকে অবশ্যই সময় দিচ্ছি, সময় দেব। কিন্তু বার বার প্রশ্ন আসে যেÑ সেই সময় কতদিন?

এ প্রশ্ন উত্থাপন করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সেই পর্যন্ত সময় দেব, যেটা যৌক্তিক এবং যে সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। আমরা রাজনীতি করি বলেই আন্দোলন করেছি, জান দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য একটাইÑ আমরা জনগণের ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এই সরকারকে অতি দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজসম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চায় বলে জানিয়েছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় সংলাপে যোগদান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই সরকারকে নিরপেক্ষ থেকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে হবে। সে জন্য আমরা সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেটা কতদিনের, তা আমরা পরে জানাব।

তিনি বলেন, আগামীতে জাতির সামনে একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া বর্তমান সরকারের মূল কাজ। সে জন্য মৌলিক বিষয়ে তাদের কিছু সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে সংস্কার করা উচিত, সে বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। জামায়াতের পক্ষ থেকে সরকারকে দুইটি রোড ম্যাপ দেওয়া হয়েছে। একটি সংস্কারের, অন্যটি নির্বাচনের। ভোটের আগে সংস্কার চায় জামায়াত। আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন।

সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমই শুরু হয়নি
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘যৌক্তিক সময়’ কথাটির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের কর্ম সম্পাদনের বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অর্থাৎ সংস্কার কর্মসূচিসম্পন্ন হওয়ার পরই অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

এদিকে ছয়টি কমিশনের ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরুর কথা ছিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা কাজ করে রিপোর্ট দেবে। সরকার এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। গত ৫ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বসেছেন সরকার। এখনো সংস্কার কাজ শুরু না করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কমিশন কাজ শুরু করার কথা ছিল ১ অক্টোবর থেকে। এখনো প্রজ্ঞাপন হয়নি। তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। ৩১ ডিসেম্বর ছয়টি কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে তাদের বসার কথা। এরপর নির্ভর করবে নির্বাচনের আগে কি কি সংস্কার কাজ তারা করতে চান এবং কোন কোন কাজ পরের নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেবেন।

তিনি বলেন, এটি আপেক্ষিক বিষয়। ছয় মাসও হতে পারে আবার এক বছরও হতে পারে, কেউ মনে করতে পারে পাঁচ বছর লাগবে। আমার ব্যক্তিগত মত, কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করে আগামী বছর নির্বাচনের জন্য ব্যয় করবে। এখন নির্বাচন কমিশন নেই। নির্বাচন কমিশন আইন লাগবে। ইসি গঠনসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা বড় কাজ। এতে ৮-৯ মাস সময় লেগে যাবে। এসব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এখনই কমিশনের কাজ শুরু করা দরকার। পাশাপাশি একই সঙ্গে ইসির কাজও শুরু করা দরকার। এজন্য সর্বোচ্চ আগামী বছরটা তাদের দেওয়া যেতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের পর নির্বাচন
গত বুধবার প্রকাশিত বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপে এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর বা তার বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৪৭ শতাংশ ভোটার। আর ৫৩ শতাংশ মনে করেন, এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘অন্তত দুই থেকে তিন বছর’ দায়িত্ব পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ২০ সম্পাদকের মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, গত শনিবার রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়ে বলেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার যেন ‘যৌক্তিক সময়’ পর্যন্ত থাকে। এই যৌক্তিক সময় আসলে কতটুকু? এ বিষয়ে ড. ইউনূস দেশের শীর্ষ সম্পাদকদের কাছে জানতে চেয়েছেন। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কী কী কাজ করতে হবে, ন্যূনতম কতটুকু কাজ করতে হবে -এসব প্রশ্ন রেখেছেন।’

সম্পাদকদের মতামত তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন রকম কথা এসেছে, সর্বনিম্ন যে সময়টা এসেছে- ২ বছর যাতে এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হয়। অনেকে আবার দুই থেকে তিন বছরের কথা বলেছেন।’

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিটির প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বল্প সময়ে কোনোভাবেই সংস্কার সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের কিছু ক্ষেত্র ও প্রতিষ্ঠান একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ক্ষেত্রগুলো সংস্কারে সময় লাগবে। যে ছয়টি কমিশন হয়েছে- আমার মনে হয়, আরো কমিশন করার দরকার আছে। এসব কমিশনের কাজ শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সমাঝোতার পর সংস্কার। এই সংস্কারের আগে নির্বাচন করা হলে সংস্কারের অভীষ্ঠ লক্ষ্য কখনোই পূরণ হবে না। কাজেই আগে সংস্কার। পরে নির্বাচন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সময় নির্দিষ্ট করে আমি বলতে পারব না। আগে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের যে অভীষ্ঠ লক্ষ্য সেগুলো পূরণ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা যে রাজনৈতিক সংলাপ ডেকেছেন, আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই তা এগিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যে মূল চেতনা, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আগেই যদি নির্বাচন হয়, তাহলে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

 

ভোরের আকাশ/রন