logo
আপডেট : ৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০৪
প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
ভাষা সৈনিক মতিনের চোখে পৃথিবী দেখছেন রেশমা
রুহুল আমিন

ভাষা সৈনিক মতিনের চোখে পৃথিবী দেখছেন রেশমা

আজ ৮ অক্টোবর ভাষা সংগ্রামের এই বীর সন্তানের মৃত্যুবার্ষিকী। আব্দুল মতিন ২০১৪ সালের এইদিন সকাল ৯টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে দীর্ঘদিন তিনি একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার ধুবুলিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আব্দুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। মতিন ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান। জন্মের পর তাঁর ডাক নাম ছিল গেদু। বর্ণমালার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছেই।১৯৩০ সালে গ্রামের বাড়ি যমুনা ভাঙনে ভেঙ্গে গেলে আবদুল জলিল জীবিকার সন্ধানে ভারতের দার্জিলিং এ চলে যান। সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইস স্টাফ হিসেবে একটি চাকরি পেয়ে যান। ১৯৩২ সালে আব্দুল মতিন শিশু শ্রেণিতে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন এবং তখন সেখানেই তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।

১৯৩৩ সালে আব্দুল মতিনের মাত্র ৮ বছর বয়সে তার মা অ্যাকলেমশিয়া রোগে মারা যান। শিশু মতিন মহারানী গার্লস স্কুলে ৪র্থ শ্রেণী পাশ করলে ১৯৩৬ সালে তাকে দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। তিনি ১৯৪৩ সালে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা) পরীক্ষায় ৩য় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন।

ওই বছরই রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি হন আব্দুল মতিন। ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আব্দুল মতিন ব্রিটিশ আর্মির কমিশন র‌্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা, আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টসে (পাস কোর্স) ভর্তি হন। ফজলুল হক হলে তাঁর সিট হয়। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস।

ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনি অন্যতম ভূমিকা পালন করেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন।

সেই ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের দান করা চোখের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফেয়েছে রেশমা নাসরীন । সে ঢাকার ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়নের ঈশাননগর গ্রামের মৃত বারেক মেলেটারীর মেয়ে। রেশমা একজন স্বাস্থ্যকর্মী। মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার চর আজিমপুর গ্রামে রেশমার শ্বশুরবাড়ি। স্বামী আব্বাস আলী একজন ব্যবসয়ী। রেশমা স্বামী ও ১৫ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মিমি এবং ৩ বছরের ছেলে সন্তান রাইয়ান বিন আয়ানকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন।

২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর সাতাশি বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অসুস্থতায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে জান ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। মৃত্যুর পূর্বে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই নিজের দেহ দান করে যান চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য এবং তার চোখ দুটি দান করে দিয়ে যান সন্ধানীকে।

সেসময় টিভিতে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের মৃত্যু ও তার চোখ দুটি সন্ধানীকে দান করে যাওয়ার খবর চাউর হলে সন্ধানীর সাথে যোগাযোগ করেন ধামরাইয়ের রেশমা নাসরীন ও তার পরিবার। রেশমার তখন বাম চোখের কর্নিয়ায় সমস্যা ছিলো। পরে ওই মাসেরই ১৪ অক্টোবর সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে রেশমার বাম চোখে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের দান করা একটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়।সেদিন রেশমার আগে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের আরেকটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বাংলাবাজার চাঁদগাজী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ইকবাল কবিরের বাম চোখে।

অহঙ্কারমুক্ত লোভ লালসাহীন একজন সহজ-সরল মানুষ ছিলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। ক্ষমতার মোহ তাকে কখনো কাবু করতে পারেনি। তিনি সাধারণভাবে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ভাবতেন। মরে গিয়েও তিনি দুজনকে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দিয়ে যান।

মোবাইলফোনে ইকবাল কবির জানান, রেশমার আগে আমার চোখ অপারেশন করা হয় সেদিন। আমি ধন্য ও কৃতজ্ঞ ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের প্রতি। তার একটি কর্নিয়া আমার চোখে পেয়ে। কিন্তু অপারেশন তেমন ভালো না হওয়াতে দুই বছর পর আমার ওই চোখে সমস্যা দেখা দেয়। পরে ইন্ডিয়া গিয়ে ভাষা মতিনের কর্নিয়াটি পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। আমার এখনো একটু সমস্যা আছে। চশমা ছাড়া দেখা কষ্টকর হয়ে যায়।রেশমা নাসরীন জানান, আমি ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের কর্নিয়া পাওয়ার পরই তার পরিবারের সাথে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমি খুঁজে পাইনি। প্রায় আট বছর অপেক্ষা করার পর কিছু দিন আগেই আমি ভাষা সৈনিকের পরিবাবের সাথে দেখা করেছি। আমি এখন খুব খুশি।

তিনি আরও বলেন, আমি দু’চোখ দিয়েই দেখতে পাই। যদিও আমার চশমা লাগে। তারপরও এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি শুধু একটি নতুন চোখই পাইনি, আমি একজন ভাষা শহীদের চোখ পেয়েছি। আমি আমার দুই সন্তানকেও ভাষা মতিনের আদর্শে গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ। কারণ আজকে আমি পৃথিবীর আলো দেখছি একজন মহান মানুষের কর্ণিয়া দিয়ে।

 

ভোরের আকাশ/রন