logo
আপডেট : ৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:০৮
শিবিরের উত্থানে ক্যাম্পাসে অস্বস্তি
এম সাইফুল ইসলাম

শিবিরের উত্থানে ক্যাম্পাসে অস্বস্তি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনাকে মেনে নিতে পারছে না। তারা এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার ভূমিকার বিষয়টি সামনে এনেছেন অনেকেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ শাসনামলে পরিচয় গোপন করে ছাত্রলীগের সঙ্গে মিলেমিশে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে শিবিরের বিরুদ্ধে, যা ভালো চোখে দেখছে না ছাত্রদল থেকে শুরু করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো।

তবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, অনেকেই না বুঝে শিবিরের বিরুদ্ধে মুখরোচক বক্তব্য দিচ্ছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পরিচয় গোপন রেখে সুবিধা নেয়ার অভিযোগের একটিও প্রমাণিত নয়। মূলত ছাত্রদের কল্যাণেই শিবির ক্যাম্পাসে কাজ করে। নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য রাজনীতি করে না শিবির। তাই ক্যাম্পাসের বড় একটি অংশ শিবিরের আদর্শ ধারণ করায় কেউ কেউ সেটি সহ্য করতে পারে না বলেই পাল্টা অভিমত সংগঠনটির নেতাদের। তাদের ভাষ্য, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে শিবির ট্যাগ দিয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদেরও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মীদের গুম করা হয়েছে। এই গুমের শিকার হয়েছেন নিরীহ শিক্ষার্থীরাও। তখন শিবির হত্যা, নির্যতান এক প্রকার জায়েজ ছিল। কারণ শিবির ট্যাগ দিলে তেমন কোনো প্রতিবাদ হতো না। এ কারণে ভিন্ন কৌশলে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে হয়েছে। গত সাড়ে ১৭ বছর যে সংগঠনটি ফ্যাসিস্ট রেজিমের শিকার, সেই সংগঠনের বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ তোলা মানবাধিকার পরিপন্থী বলেই মত তাদের।

ইসলামী ছাত্রশিবির মূলত জামায়াতের ইসলামীর ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্রসংঘ’। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালে ছাত্র সংগঠনটি ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করে। মাঝেমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাময়িক ঝামেলায় পড়লেও তারা সেখানে অন্তরালে থেকে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতির পর থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে কার্যক্রম অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর শিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হয়। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পর থেকে ছাত্রশিবির আরও চাপে পড়ে যায়। গত ১৫ বছর বিগত সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রশিবিরকে মাঠে নামতে দেয়া হয়নি। তবে, সংগঠনটির কার্যক্রম কোনো সময় থেমে থাকেনি। বরং ‘নীরব’ এবং ‘কৌশলী ভূমিকায়’ ছাত্রশিবির কাজ করেছে। মেধাবী নেতৃত্ব তৈরিতেও মনোযোগী ছিল এই সংগঠনটি।

‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে’ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সংগঠনটি আলোচনায় আসে। গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্লাস শুরুর আগের দিন ১০ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানসহ ঢাবি প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ সময় শিবিরের পক্ষ থেকে বৈঠকে যোগ দেন সভাপতি সাদিক কায়েম ও সাহিত্য সম্পাদক রেজাউল করিম শাকিল। এরপর ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন কায়েম। তিনি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়া হয়ে সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। গত পাঁচবছর তিনি হলে গোপনে চালিয়েছেন সাংগঠনিক কার্যক্রমও। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর আগে খাগড়াছড়ির বাসিন্দা কায়েমকে ক্যাম্পাসে অনেকেই চিনতেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি এবং হিল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। সাদিক কায়েমের পরিচয় প্রকাশের পর ফেসবুকজুড়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে ইসলামী ছাত্রশিবির। বিশেষ করে সাদিক কায়েমের প্রকাশ্যে আসার পর ঢাবি সেক্রেটারি পরিচয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর পরপরই সেক্রেটারি এসএম ফরহাদের পরিচয়ও জানা যায়। তিনি সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পর এ নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ফরহাদ ছাত্রলীগেরও পদধারী ছিলেন বলে গুঞ্জন রটে। তিনিও নেতৃত্বে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও। তবে ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি বা কার্যক্রমের সঙ্গে নিজের কোনোরকম সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেছেন ঢাবি শিবির সেক্রেটারি এসএম ফরহাদ। তিনি ভোরের আকাশকে বলেছেন, ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এরপর গত ২ নভেম্বর ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ঢাবি ছাত্রশিবিরের কমিটির ঘোষণা করে সংগঠনটি।

এ ছাড়া গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির পরিচয়। তার নাম আব্দুল মোহাইমিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। ৩০ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাবি শাখার সেক্রেটারির পরিচয়ও জানা যায়। তার নাম মো. মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। মোস্তাকুর রহমান জাহিদ রাবির অ্যাগ্রোনোমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী।

২৪ সেপ্টম্বর এবার প্রকাশ পায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম সভাপতি ও মার্কেটিং বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ ইব্রাহিম বর্তমান ছাত্রশিবিরের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সর্বশেষ প্রকাশ্যে কার্যক্রম ছিল ২০১৫ সালে। এর পর থেকে সংগঠনটি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম করেনি। এ ছাড়া সম্প্রতি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ ক্যাম্পাসে সংগঠনটির নেতাদের নাম প্রকাশ্য এসেছে।

বিশেষ করে দেশের বড় তিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ছাত্রশিবিবের নেতাদের নাম প্রকাশ্যে আসার পর নানা আলোচনা শুরু হয়। শিবির নেতাদের বেশিরভাগই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই সমন্বয়কারী। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও পক্ষে-বিপক্ষে প্রশ্ন করতে দেখা যাচ্ছে। টিভি টক শোসহ ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শিবিরকে নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। ২৮ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে ছাত্রশিবিরকে উদ্দেশ্য করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেছিলেন, আপনারা এমন কোনো ষড়যন্ত্র করবেন না। আবার ১৯৭১ সালের মতো আপনাদের আবার বড় ধরনের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। এভাবে এই গোপন সংগঠনের তৎপরতা ইতোমধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদেরকে বয়কট করেছে। আর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছেন।

তিনি বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রদল প্রতিটি ক্যাম্পাসে কমিটি দিয়ে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রকাশ্যে দিবালোকে আমাদের কর্যক্রম পরিচালনা করছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি গোপন ও নিষিদ্ধ সংগঠন রয়েছে; তারা সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের পতাকাতলে থেকে এবং তাদের আশ্রয়ে থেকে তারা একজনও প্রকাশ্যে আসার সাহস পায়নি।

ছাত্রদল সভাপতির এমন বক্তব্যের পর বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা ও সমালোচনা। এবার বিষয়টি নিয়ে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয় ইসলামী ছাত্রশিবির। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম ওই নির্দেশনায় বলেছেন, সম্প্রতি ছাত্রদল সভাপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লেখালেখি করছেন। আমরা আমাদের সব দায়িত্বশীল ও জনশক্তি ভাইদের প্রতি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখানোর আহ্বান। এরপর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আাসে। কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকেই ছাত্রশিবির ইস্যুতে কথা বলছে। ছাত্রশিবিরকে নিয়ে কেন অন্যান্য দলের এই অস্বস্তি তা জানতে ভোরের আকাশ এর পক্ষ থেকে কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাঈন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, যেকোনো সংগঠনের ক্ষেত্রেই গুপ্ত অবস্থা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু ছাত্র শিবিরকে আমরা দেখছি, তারা বিভিন্ন সময়ে গোপনীয়ভাবে কাজ করে। এ ছাড়া এই সংগঠনের সাবেক নেতাদের একাত্তরের ভূমিকা প্রশ্নবোধক। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা এটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, যখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দখলদারিত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এমনকি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে যারা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই শিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ সমস্ত বিষয়ে শিবির এখনও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীরাই নির্ধারণ করবে শিবিরের রাজনীতির বিষয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় বলেন, ছাত্রশিবির গত ১৫ বছর স্বাভাবিকভাবে নিজেদের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি বা করেনি। কিন্তু তারা অন্য সংগঠনের ভেতর ঢুকে তাদের কার্যক্রম গোপনে করেছে। তারা এখনও গোপন-ওপেন খেলা খেলছে এবং সেটি সম্পর্কে আমরা সোচ্চার রয়েছি। তারা হাসিনা সরকারের আমলে ছাত্রলীগের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হলে থেকেছে। এজন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, যে শিবির হল দখল করেছে। ছাত্রশিবিরের এসব বিষয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেয়নি।

গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি নিশান আহমেদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের ঐতিহ্য বহন করছে। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৮৩ শিক্ষা আন্দোলন, ’৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থান ঢাবির ভূমিকা দেশবাসী জানে। চব্বিশের গণহত্যাকারীকে হটিয়ে একাত্তরের গণহত্যার সহযোগীদের পুনর্বাসন করা কোনো শুভচিন্তার প্রকাশ হবে বলে মনে করি না। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের সুবিধা নিয়ে ফ্যাসিস্ট রেজিমের অংশীদার ছিল। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বাইরে আসার সক্ষমতা যে রাজনৈতিক শক্তির থাকবে না তার রাজনৈতিক চর্চা দিন শেষে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানই করবে। তিনি বলেন, আজ যদি ক্যাম্পাসে শিবিরের রাজনীতি করার বৈধতা দেয়া হয় তবে তা হবে গণহত্যা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।

বিষয়টি নিয়ে আবু সাদিক কায়েম ভোরের আকাশকে বলেন, পরিস্থিতির কারণে এতদিন নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের তাণ্ডবে কেউ ক্যাম্পাকে স্বাভাবিকভাবে ছাত্র রাজনীতি করতে পারেনি। এমন কী রাজনীতি করা তো দূরের কথা সবসময় সাধারণ ছাত্ররা থাকতেন আতঙ্কে। আর এবারের ছাত্র আন্দোলন কোনো দলীয় প্ল্যাটফর্ম ছিল না। তিনি বলেন, এটি ছিল গণমানুষের আন্দোলন। এছাড়া ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সঙ্গে থেকে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অভিযোগটি ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, এটি মুখরোচক বক্তব্য। একটি ঘটনাও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাদেক আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ‘স্বৈরাচার’ শেখ হাসিনামুক্ত করাটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। সেই টার্গেটে আমরা কাজ করেছি। সব সময় আমাদের কার্যক্রম ছিল স্বাভাবিক। যদি কেউ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে সেটি দেখতে পারবেন। আর ১৯৭১ সালে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের জন্ম হয়েছে ১৯৭৭ সালে। আমরা সবসময় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করি। আর ছাত্রশিবিরের নিয়ে যারা বক্তব্য দেয় তাদের অধিকাংশ না জেনে বক্তব্য দেন। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা, বিশ্বজিত হত্যার কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এরকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেখানে শিবির ট্যাগ দিয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। গত ১৭ বছরে শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীকেত হত্যা, গুম করা হয়েছে। এসব ঘটনা আড়াল করতে সরকার শিবির ট্যাগ দিয়েছে। আর তাতে অন্যরা চুপ থেকেছে। এ কারণে শিবির গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, অনেকেই বলেন ছাত্রশিবির এবারের আন্দোলনে কৌশল অবলম্বন করেছে। আমরা বলেছি, আমাদের কৌশলে ছাত্র-জনতা এক হয়ে প্রিয় বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে। সম্প্রতি দেয়া ফেসবুক স্টাটাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ব্যক্তি, দল ও মতের কাছে আহ্বান করছি, আপনারাও এমন শত কৌশল করে এই দেশটাকে ভালো কিছু দিন। আমরা আপনাদের পাশে থাকবো। ছাত্রশিবির ছাত্র কল্যাণে কাজ করে। নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য রাজনীতি করে না। তাই ক্যাম্পাসের বড় একটি অংশ আমাদের আদর্শ ধারণ করায় অনেকে সেটি সহ্য করতে পারে না। তিনি বলেন, অন্যরা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারলে শিবির কেন নয়?

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ভোরের আকাশকে বলেন, ছাত্রদল বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে যারা সর্বশক্তি দিয়ে যারা আন্দোলন করেছে তাদের কারো সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মত পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু শত্রুতা বা সংঘাত, সংঘর্ষ হতে দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে গোপন তৎপরতার মাধ্যমে কখনও জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করা সম্ভব নয়। গোপনে একদলের নেতা হয়েও প্রকাশ্যে অন্য সংগঠনের পদবি ধারণ করা প্রতারণামূলক আচরণ। আমরা ছাত্রশিবিরকে গোপন তৎপরতা, আত্মপরিচয়ের সংকট ও অনুপ্রবেশের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা করার আহ্বান জানাচ্ছি।

 

ভোরের আকাশ/রন