logo
আপডেট : ১২ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:৪৯
ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের রূপরেখা দিচ্ছে না কেউ
জুবায়ের হোসাইন, ঢাবি প্রতিবেদক

ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের
রূপরেখা দিচ্ছে না কেউ

সংস্কারের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালু রাখার দাবি জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। কিন্তু কী সংস্কার করা হবে; সেই প্রস্তাবনা দেয়নি কেউ। ফলে সংস্কার নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দখলদারিত্ব ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে সরব থাকতে দেখা যায় তাদের। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করে শ্রেণি কার্যক্রম চালু করার ঘোষণা দিলে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধেরও ঘোষণা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত শ্রেণি কার্যক্রম চালু করতে গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিন্ডিকেটের সেই জরুরি সভায় ক্যাম্পাসে সব ধরনের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য সেখানে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে জানান। তবে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাজনীতির বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা মতামত দিয়েছেন। সেগুলো পর্যালোচনা করে শিগগিরই একটি সারসংক্ষেপ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেটা নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। রাজনীতি বন্ধের খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কোনো ছাত্র সংগঠনই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে অবস্থান না করলে সেপ্টেম্বরের ২১ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে ঢাবি প্রশাসন। সেখানে ২ দফায় ৯টি ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাবি প্রশাসন। সেখানে সংস্কার করে ছাত্র রাজনীতি চালু রাখার প্রস্তাব দেয় ছাত্র সংগঠনগুলো।

আলোচনায় ছাত্র রাজনীতির যৌক্তিক সংস্কার করে ক্যাম্পাসে সুস্থ ধারার ও শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতি চালু রাখার দাবি জানান সব ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা। এর ২০ দিন পার হয়ে গেলেও এখনও হয়নি কমিশন। পাশাপাশি ছাত্র সংগঠনগুলোও দেয়নি কোনো প্রস্তাব।

সংস্কার ও নীতিমালা সম্পর্কে ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ সারাদেশে তাদের সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। মতবিনিময় শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে ছাত্রদল আনুষ্ঠানিক রূপরেখা প্রকাশ করবে। তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি হবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে। আমাদের রূপরেখায় ছাত্রলীগের দীর্ঘ দেড় দশকের এই কলুষিত রাজনীতির বিপরীতে শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতি উপহার দিবে।

ঢাবি ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ বলেন, আমরা অফিসিয়ালি এখনও কোনো নীতিমালা বা প্রস্তাবনা দিইনি। আমাদের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অথোরাইজেশনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। ছাত্র রাজনীতি হলভিত্তিক না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হবে। কার্যক্রম হলে নয়; হবে রাজু ভাস্কর্য বা মধুর ক্যান্টিনে। ছাত্র নেতা হলে থাকবে ছাত্র পরিচয়ে। রাজনৈতিক কোনো প্রভাব হলে থাকবে না। কারও ওপর চাপ প্রয়োগ করে রাজনীতিতে যুক্ত করা যাবে না। তবে ডাকসু সম্পর্কে এখনই কোনো নির্দেশনা দিতে চাননি এই শিবির নেতা।

ঢাবি ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, এখানে এমন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে ভবিষ্যতে আর কোনো দল ক্যাম্পাস দখল করতে না পারে। সেই ক্ষেত্রে ১ম বর্ষ থেকে বৈধ সিট নিশ্চিত করা প্রধান শর্ত বলে আমরা মনে করি। সামনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস হবে গণতান্ত্রিক, পরমতসহিষ্ণু, মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্র। যেখানে থাকবে না কোনো পেশিশক্তির প্রদর্শনী, থাকবে না অস্ত্রের ঝনঝনানি। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন তথা ডাকসু নির্বাচন একাডেমিক ক্যালেন্ডারে একটা নির্দিষ্ট তারিখের জন্য নির্ধারিত করা হবে; নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই আটকে রাখা যাবে না। ডাকসুর গঠনতন্ত্রের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে হবে। ডাকসুর সভাপতি ছাত্রদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবে, কোনোভাবেই সভাপতি ভিসি হতে পারবেন না পদাধিকার বলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশও সংস্কার করতে হবে। আশা করি, প্রশাসনের প্রতিশ্রুত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ একটা গণতান্ত্রিক রূপরেখা হাজির করবে ছাত্র সংগঠনগুলোর সংস্কার প্রস্তাবের আদলে।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নিশ্চিতের লক্ষ্যে এসবের মূল কারণ আবসন সংকট দূর করে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে সিট বণ্টন করা, গণরুম-গেস্টরুম নিষিদ্ধ করা, সুষ্ঠু ও কার্যকরী ছাত্র সংসদ নিশ্চিত করা জরুরি। যেহেতু প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব কায়েমের সুযোগ হয় তাই সবক্ষেত্রে প্রশাসনের কার্যকরিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ভিসি, সিনেট ও সিন্ডিকেট নির্বাচন সঠিক প্রক্রিয়ায় করা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলীয় প্রভাব বন্ধ করা, স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

সংস্কার প্রসঙ্গে ঢাবি উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে তারা যে সুপারিশ দেবে তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যালোচনা করে দলীয় রাজনীতি থাকবে কিনা সেটি নির্ধারণ করবে।

জানা গেছে, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ও অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামদের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে। তারা ক্যাম্পাসের সব অংশীজনদের মতামত ও বক্তব্য নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির বিষয়ে সুপারিশ দেবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটে তাদের এই সুপারিশ পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এই কমিটি গঠনের পর ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির কোনো ধরনের কার্যক্রম চালানো যাবে না বলে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, এ সময়ে রাজনীতি বন্ধ রাখতে হবে। তবে ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদ কিংবা ক্লাবভিত্তিক যে কার্যক্রম সেটা তার মধ্যে পড়বে না।

 

ভোরের আকাশ/রন