আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন সিন্ডিকেট নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সার্ভারে সংরক্ষিত থাকা ১১ কোটি নাগরিকের তথ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছে। ৪৬ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে বিক্রি করায় নাগরিকদের আর্থিক লেনদেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও জীবনে নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) যাচাই সেবা গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনের তথ্য-উপাত্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় বা বিক্রি করতে পারবে না। চুক্তি অনুসারে, ১১ কোটির বেশি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অনুলিপি তৈরি করে ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে দেয়া হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এসব তথ্য ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক উদ্দেশে সরবরাহ করে। ডিজিকন এসব তথ্য পরিচয় ডটকম নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ১৮০টির বেশি দেশি-বিদেশি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থের বিনিময়ে ৫ বছর ধরে বিক্রি করছে। এসব তথ্য বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কাফরুল থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তারেক বরকতউল্লাহসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিগত তথ্য অন্য ব্যক্তির হাতে পড়ায় অনলাইন ব্যাংকিং, লেনদেন, কেনাকাটায় ঝুঁঁকি তৈরি হয়েছে। তথ্য ফাঁস হলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-মেইলসহ অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাক হতে পারে। এর মাধ্যমে দুর্বৃত্তরা ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা বিশেষ করে জন্মনিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন সরকারি ভাতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভোগান্তি হতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ব্যক্তিগত তথ্য অন্যের হাতে গেলে নাগরিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। একজনের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে অন্য কেউ অপরাধ করতে পারে। এতে বিনা অপরাধেই কেউ কেউ ফেঁসে যেতে পারে। ব্যাংক বা কার্ডের পাসওয়ার্ড চুরি করে অর্থ চুরি করতে পারে হ্যাকাররা। এর মাধ্যমে অর্থ লোপাট করতে পারে। ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সময় নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের সময় এসব বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহককে জিজ্ঞাসা করে। দুর্বৃত্তদের হাতে ব্যক্তিগত তথ্য থাকলে তারা পরিচয় লুকিয়ে পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের মাধ্যমে অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে নিয়ে অর্থ সরিয়ে ফেলবে। একই ঘটনা ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। সুমন আহমেদ বলেন, এনআইডির ব্যক্তিগত তথ্য রাষ্ট্রের কাছে আমানত। এর সুরক্ষা দেয়া সরকারের কর্তব্য। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক হতে হবে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু তথ্য বেহাতের ঘটনা ঘটেছে, সে জন্য ব্যবহারকারীদেরও সচেতন থাকতে হবে। অনলাইন লেনদেন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সতর্ক হতে হবে।
ভোরের আকাশ/রন