প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে বিগত সরকারের প্রভাবশালী ৯৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) বিগত সরকারের এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির চলতি ও গত পাঁচ করবর্ষের আয়কর নথি খতিয়ে এ তথ্য পেয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে অর্থ পাচারের পরিমাণ কর ফাঁকির কয়েক গুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তদন্ত চূড়ান্ত হলে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে এনবিআর সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রভাবশালী এ ৯৩ ব্যক্তির মধ্যে বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য মিলিয়ে ৩৩ জন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ৯ জন, কাউন্সিলর ১১ জন, আমলা ১৫ জন এবং সরকারের কাছের লোক বলে পরিচিত ২৫ জন বড় ব্যবসায়ী আছেন। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ও শুল্ক-কর পরিশোধের ও অর্থ পাচারের বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
জানা যায়, অভিযুক্ত এই ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে বকেয়া এসব রাজস্ব পরিশোধ করেননি। এমনকি এনবিআর থেকে চিঠি পাঠানো হলেও তারা তা আমলে নেননি বরং এনবিআরের যে কর্মকর্তা বকেয়া পরিশোধের জন্য কথা বলেছেন, তাকে ওপরের মহল থেকে হয়রানি করা হয়েছে। কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯৩ ব্যক্তিই দায়সারাভাবে রিটার্ন জমা দিয়েছেন। অনেকে পাওনা না দিয়ে উল্টো মামলা করে আদায় প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কমপক্ষে ২৫ ব্যবসায়ী পাওনা রাজস্ব পরিশোধ না করে গত ১৫ বছরে প্রায় ২০০ মামলা করেছেন। এসব মামলার কারণে ঝুলে আছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এসব মামলা করে নিষ্পত্তি হবে তার কোনো সময়সীমা নেই।
গত সপ্তাহ পর্যন্ত এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের তদন্তে সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হকের কর ফাঁকির পরিমাণ ১৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৭১২ কোটি টাকা। আসাদুজ্জামান খান কামালের কর ফাঁকি ১৭ কোটি টাকার বেশি ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওবায়দুল কাদেরের কর ফাঁকি ২৬ কোটি টাকা ও অর্থ পাচার ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। শাজাহান খানের কর ফাঁকি ৩৪ কোটির বেশি এবং পাচার ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। টিপু মুনশির কর ফাঁকি ২৩ কোটি টাকা এবং পাচার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। দীপু মনির কর ফাঁকি ৯ কোটি টাকা ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামছুল হক টুকুর কর ফাঁকি ১২ কোটি টাকা ও অর্থ পাচার ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের কর ফাঁকি ১১ কোটি টাকা ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। জুনাইদ আহমেদ পলকের কর ফাঁকি ৩৪ কোটি ও অর্থ পাচার ১১ হাজার কোটি টাকা। জুনাইদের স্ত্রী কনিকার কর ফাঁকি ৮ কোটি টাকা ও পাচার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খানের কর ফাঁকি ৯ কোটি ও অর্থ পাচার ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদের ভাষ্যমতে, সরকারের এসব রাঘব বোয়ালদের প্রভাব ও হুমকি-ধমকির কারণে তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে পাওনা রাজস্ব আদায় ও পাচার করা অর্থ ফেরত এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হলে এসব অপকর্ম কমবে।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবদুর রহমান খান। দায়িত্ব গ্রহণের পরই সিআইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। তিনি এনবিআরের পাওনা রাজস্ব এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে পদক্ষেপ নেয়ার কঠোর নির্দেশ দেন। কোন দেশে কী কৌশলে অর্থ পাচার করা হয়েছে, তা উদ্ঘাটনের জন্যও নির্দেশ দেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
আবদুর রহমান খান বলেন, অর্থ পাচারকারী ও কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে এনবিআর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কর ফাঁকিবাজ ও অর্থ পাচারকারী যত বড় প্রভাবশালীই হোক- তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে সৎ করদাতারা এনবিআরের কাছে সম্মানিত। এনবিআর তদন্তের প্রয়োজনে সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, কাস্টম হাউসসহ আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছে। এ পর্যন্ত তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডসহ ২৫ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৫ লাখ টাকা কোটি টাকার বেশি। ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিমের কর ফাঁকি ২০০ কোটি টাকা, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের কর ফাঁকি ৪১২ কোটি টাকা, সামিটের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের কর ফাঁকি ৭০০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে শায়ান ফজলুর রহমান, সালমান এফ রহমানের ভাই এ এস এফ রহমান ও তার ছেলে শাহরিয়ার রহমান এবং তাদের মালিকানাধীন মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এলসির বিপরীতে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ছাড়ানোর তথ্য পোয়া গেছে। এদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস, অটাম লুপ অ্যাপারেলস, বেক্সটেক্স গার্মেন্টস, কসমোপলিটান অ্যাপারেলস, কোজি অ্যাপারেলস, এসেস ফ্যাশন, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস, কাঁচপুর অ্যাপারেলস, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস, পিয়ারলেস গার্মেন্টস, পিংক মেকার গার্মেন্টস, গার্মেন্টস, প্লাটিনাম স্কাইনেট অ্যাপারেলস, স্প্রিংফুল অ্যাপারেলস, আরবান ফ্যাশনস ও উইন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস লিমিটেড। এখন পর্যন্ত এসব ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির পরিমাণ ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তদন্ত চূড়ান্ত করার পর কর ফাঁকি ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে, প্রভাবশালী আলোচিত ২৫ ব্যবসায়ীর অনেকেই নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির নামে কয়েক হাজার কোটি অর্থ পাচার করেছেন। ব্যাংক লেনদেনের সঙ্গে রিটার্নে দেয়া তথ্যের ব্যবধান নিরূপণ করে পাচার টাকার পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে। এখানে বিবেচনায় আনা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামালের দাম ও পরিমাণ, মজুরি, আমদানি-রপ্তানির সব তথ্য। প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে ঋণপত্রে (এলসি) দেয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কতটা পণ্য কী দামে রপ্তানির জন্য চুক্তি করা হয়েছিল এবং রপ্তানির কতটা অর্থ দেশে আনা হয়েছে, তা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ২৫ ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এলসিতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে আয় ও মুনাফার যে হিসাব রয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত আছে।
এনবিআরের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গড়ে প্রতিবছর রাজস্ব ঘাটতি থাকছে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই ৯৩ ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠান নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করলে এনবিআরের আদায়ে ঘাটতি হতো না।
প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রতিবছরই এসব ব্যক্তির আয় ও সম্পদ বাড়লেও তারা সেই তথ্য রিটার্নে উল্লেখ করেননি। ৫ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা দামের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি থাকলেও অনেকে একটি গাড়ির তথ্যও রিটার্নে দেননি। অনেকে একটি বা দুটির তথ্য দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দাম কম দেখানো হয়েছে। স্বর্ণ-হীরা-প্লাটিনামের শত শত ভরি গহনা থাকলেও তার তথ্য নেই রিটার্নে। এনবিআর থেকে যাদের আয়কর রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে তার মধ্যে আরও আছেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (বরখাস্ত), পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, আব্দুর রহমান বদি, তার স্ত্রী শাহীন আক্তার প্রমুখ।
ভোরের আকাশ/রন