logo
আপডেট : ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:০৭
পোশাক ও বস্ত্র শিল্প নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
ড. মো. আইনুল ইসলাম

পোশাক ও বস্ত্র শিল্প নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

ক্ষমতার পালাবদলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মালিকদের উদ্বেগ, শ্রমিকদের অসন্তোষ, আন্দোলন, কর্মবিরতি ও একের পর এক কারখানা বন্ধের ঘটনায় রপ্তানি আয়ে ৮৪.৫৮ শতাংশ অবদান রাখা বস্ত্র ও পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উৎপাদন তলানীতে নেমে যাওয়া, কার্যাদেশ পাশের দেশে চলে যাওয়া, আয় কমায় ব্যাংক ঋণে বাধ্য হওয়ার পাশাপাশি বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে বড় বড় কোম্পানিও।

দেশে সরাসরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রায় ২ হাজার ৮০০ পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা নিরসনে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার জোর প্রচেষ্টা চালালেও অনেকের আশঙ্কা, জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করতে না পারলে দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহলের নানাবিধ চক্রান্তে যে কোনো সময় বড় ধরনের স্থবিরতা নেমে আসতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা এই শিল্পে। কারণ রাজনৈতিক শক্তির প্রভাববলয়ে থাকা বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত এমনিতেই ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রপ্তানি সমস্যায় ছিল।

তার ওপর জুলাই-আগস্টজুড়ে আন্দোলন ঘিরে নৈরাজ্য, সহিংসতা আর সংঘাতের পর কার্ফু জারি ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নের ঘটনায় পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই খাত নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের আস্থাহীনতা ও অনিশ্চয়তা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি কমে গেলেও দীর্ঘ চার দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমানের প্রকৃত উন্নতি না হওয়াই এই শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। মালিকপক্ষের ক্রমাগত মুনাফার মানসিকতা দমনে সরকারের যে প্রচেষ্টা থাকা দরকার, তা কখনোই দৃশ্যমান হয়নি। সরকার বরং পোশাক শিল্প মালিকদের রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এই শিল্পের জন্য বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে সামান্য অস্থিরতায় এই শিল্প বারবার ঝুঁকিতে পড়ে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে পোশাক শিল্প পরিচালনা ব্যবস্থায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, যা হবে পুরোপুরি শ্রমিকবান্ধব।

এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন মজুরি কাঠামো ও নীতির সংস্কার, শ্রম আইন সংস্কার এবং আইনি সুরক্ষা জোরদার করা, শক্তিশালী শিল্প সম্পর্ক স্থাপন এবং সামাজিক সুরক্ষা এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব না হলে এই শিল্পে সাময়িক স্বস্তি ফিরে এলেও, অস্থিরতার আশঙ্কা থেকেই যাবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত তৈরি পোশাকের পণ্যের সামগ্রিক রপ্তানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং আয় হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৪ হাজার ২৬৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের ৪৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ থেকে।

অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি আয় ইতিবাচক থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানি কমেছে ২ শতাংশ। জুলাই-মে সময়ে আয় হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ কোটি ৮১ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। প্রথম ১১ মাসে আয় হয়েছে ৭৪৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। গত বছর একই সময় আয় হয়েছিল ৭৭৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। যদিও যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আয় হয়েছে ৫১৬ কোটি ডলার, যা গত বছর ছিল ৪৫৯ কোটি ডলার।

তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত অপ্রচলিত বাজার থেকে পোশাক পণ্যের রপ্তানি আয় ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৮ কোটি ডলার, যা একই সময়ে আগের বছরে ছিল ৭৬৮ কোটি ৯ লাখ ডলার। মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ এসেছে নতুন বাজার থেকে।

বৈশি^ক নানা সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতের এই ইতিবাচক ধারায় পরিবর্তন আসতে থাকে মূলত জুন-জুলাই মাস থেকে, যা আগস্টে প্রায় পুরোপুরি নেতিবাচক ধারায় পতিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসটি শ্রমিকদের আন্দোলন ও কারখানায় অচলাবস্থায় কেটে গেলেও অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বেশকিছু পদক্ষেপ এই শিল্পে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তৈরি পোশাক খাতের শ্রম অসন্তোষের কারণে দেশের পোশাকশিল্প এখনো রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সঙ্গে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও বিদেশী রাষ্ট্রের চক্রান্ত এই শিল্পের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদেশী ক্রেতাদের অনেকে তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল অথবা পণ্যের মূল্যে ছাড় দাবি করছে। সর্বশেষ জানা গেছে, মজুরি সংকটের কারণে ৩৯টি কারখানায় শ্রমিকরা কোনো কাজ করেননি। এসব কারখানা বাঁচাতে মালিকপক্ষ সরকারের কাছে সহায়তা চাইছে। তবে অনেকে মনে করেন, দু’য়েক মাসের ধাক্কা কাটাতে অক্ষম কারখানাগুলোকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কোনো ধরনের সহায়তা না করাই উচিত হবে।

কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এসব কারখানার মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা করেছেন। সবচেয়ে বেশি শ্রমিকদের শোষণ করা এই শিল্পের মালিকরা বারবার সরকারি সহায়তা পাওয়ায়ও তাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। এমনিতেই করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সব দেশের অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভূরাজনৈতিক সংকটে বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। করোনার পর সবচেয়ে বেশি সরকারি ঋণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। মালিকেরা মুনাফা করলেও সেসব অর্থ এখনো পুরোপুরি ফেরত দেননি। সংকটের কথা বলে বারবার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়েছেন।

বিগত সরকারের সময় আইন প্রণয়নের সংসদ ও সরকারের মধ্যে পোশাক শিল্পমালিকদের বড় ধরনের উপস্থিতি, তাদের সব ধরনের সহায়তা করেছে। উৎপাদনশীলতায় প্রবৃদ্ধির একটি সীমারেখা আছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের মধ্যগগনে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্যকরণ, আরও বেশি পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আনা, আরও প্রযুক্তি আনা ও নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা শুধু পোশাক শিল্পের ওপর মনোযোগ দিয়ে নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, সরকার পরিবর্তনের পর চারদিকে যে সংস্কারের রব উঠেছে, তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্যায্য ও অসময়োপযোগী দাবিদাওয়া উপস্থাপন করাও শ্রমিকপক্ষের জন্য অনুচিত হবে। কারণ, এতে করে তৃতীয় পক্ষই উপকৃত হবে, তাদের আয়-রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ৩০ শতাংশ কার্যাদেশ বাতিলের কথা বলছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ গবেষণা বলছে, কার্যাদেশ কমেছে বড়জোর ১০-১৫ শতাংশ। ওদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ ৫ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে এই খাতের রপ্তানির ক্রয়াদেশ প্রকৃত অর্থেই কমেছে, যা সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে প্রভাব ফেলবে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ইতিবাচক নানা পদক্ষেপ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে। তবে দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের সমস্যা কাটিয়ে এই খাতকে টেকসই রূপ দিতে হলে সরকারকে স্বল্পমেয়াদি নয়, অবশ্যই কাঠামোগতভাবে মৌলিক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন মজুরি কাঠামো ও শিল্প পরিচালনা নীতির সংস্কার, মালিকবান্ধব শ্রম আইনের সংস্কার করে তা শ্রমবান্ধব করে আইনি সুরক্ষা জোরদার করা, শক্তিশালী শিল্প সম্পর্ক স্থাপন এবং সামাজিক সুরক্ষা এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এছাড়া শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ নিরসনের জন্য কারখানার মালিক, শ্রমিক ও সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যে সদিচ্ছানির্ভর গঠনমূলক আলোচনার পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ বহুপক্ষীয় সংলাপ যে কোনো ব্যবস্থায় সুশাসন ও উন্নয়ন নিশ্চিতের অন্যতম হাতিয়ার।

শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতের জন্য একটি প্রমাণভিত্তিক ও নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক জাতীয় মজুরি নীতি তৈরি করা অতীব প্রয়োজন। শ্রম আইন শক্তিশালী ও কার্যকর করতে বাংলাদেশের শ্রম আইনকে আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, যা আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকের নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে, অতিরিক্ত মূল্য সংযোজনে সক্ষম পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হবে এবং তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) ফিরে পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

ভিয়েতনাম মাত্র ৭ শতাংশ শুল্কে দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি করলেও বাংলাদেশকে দিতে হয় ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলে মোট রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়বে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক এক্ষেত্রে সবাইকে আশাবাদী করছে।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান সাময়িক সংকটে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো খুব যে উপকৃত হবে বা সবচেয়ে শ্রমঘন রপ্তানি শিল্পের পোশাক খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে পারবে; সেটা মনে করা কারও জন্যই ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের শ্রমিক সরবরাহ পর্যাপ্ত এবং মজুরিও অন্যদের তুলনায় এখনো অনেক কম। পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রেতারা চায় কম দাম, অতিরিক্ত মুনাফা এবং একসঙ্গে বৃহৎ পরিমাণ সরবরাহের নিশ্চয়তা- এসব পূরণ করার ক্ষমতা বাংলাদেশের অনেক পরিমাণেই আছে।

তাই আগামী আরও অন্তত এক দশক বাংলাদেশের পোশাকের বাজার হারানো নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলাদেশকে নিজের অর্থনীতিকে টেকসই রূপ দিয়ে জনগণের জীবনমানের প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ইতোমধ্যেই এই শিল্পে রক্ত-মাংসের মানুষের চাহিদা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই শিল্পে শ্রমিক শোষণের হারও অনেক বেশি। এছাড়া পরিবেশের জন্যও এই শিল্প বেশ ক্ষতিকর।

এ কারণেই উন্নত বিশ্ব ১০০ বছর আগে এই শিল্পকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দরিদ্র দেশগুলোতে চালান করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশকে এই শিল্প নিয়ে তাই নতুন করে ভাবতে হবে। অনেক আশাবাদ নিয়ে নীতিনির্ধারণের আসনে বসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ।

 

ভোরের আকাশ/রন