অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ বক্তব্য দিয়ে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। শুধু সমালোচনা হচ্ছে বললে কম হবে। এটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নেটিজেনদের অভিযোগ- ড. ইউনূস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেছেন। এ নিয়ে তাকে বেশ আক্রমণ করা হচ্ছে। কটাক্ষও করা হচ্ছে। অনেকে হ্যাসট্যাগ ‘স্টেপডাউন ইউনূস’ বা ‘ইউনূস হটাও’ প্রচারণা চালাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো- চাইলেই কী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা চেতনা মুছে ফেলা যাবে? এই প্রশ্নের সহজ ও একমাত্র উত্তর হলো- না, অবশ্যই না। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে; ততদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থাকবেÑ এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালে যেমন এ দেশের আমজনতা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন; তেমনি কেউ সেই গৌরবের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করলে আমজনতা-ই রুখে দাঁড়াবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গোলাম মাহবুব রাব্বানী নামে একজন লিখেছেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু কেউ যদি সেই স্বাধীনতা হরণ করতে যায়, কে কে যাবেন স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে?’ কথাটার হয়তো আপাতত বাস্তবতা নেই। কিন্তু স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে অনেকেই স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে নামবেন- এটা কিন্তু সত্য।
মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না বলেছেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস জ্ঞানী হলেও মুক্তিযুদ্ধে তার কোনও অংশগ্রহণ আমরা জানি না। রিসেট বাটন কিন্তু আমরাও চাপতে পারি। আমরা ১৯৭১ সালে রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে ওয়াশ-আউট করে বাংলাদেশ তৈরি করছি; সেভাবে আবারও রিসেট বাটন চাপ দিতে পারি।’ জেড আই খান পান্নার এই বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে শেয়ার করছেন। অনেকে আবার এও বলছেন যে তার ওই বক্তব্য আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার হাঁটুতে গুলি লেগেছে। তার বন্ধুরা যুদ্ধে মারা গেছে। তিনি বলেন, সেই সময় আমাদের সামনে ছিল- আমি নিজে বাঁচবো, যে মারছে তাকে মারবো ও দেশকে স্বাধীন করবো। আমাদের কারও কোটার চিন্তা ছিল না। এটা আমি সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছি। তো, আমার ইতিহাস উনি (মুহাম্মদ ইউনূস) মুছে দেয়ার কে? ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ কথাটা তার কলিজায় বিঁধছে। এই কথাটা হার্ট করে কি না? তাহলে তো দাঁড়ায় যে ওনার কোনও অতীত নাই। জেডআই খান পান্নার এই বক্তব্যের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষার প্রত্যয় রয়েছে। তার মতো অসংখ্য মানুষ এই বিষয়ে যেকোনো সময় রুখে দাঁড়াবেÑ এটা নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে ‘রিসেট বাটন’কে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তার ভাষ্য, মানুষের নানা বিষয় নিয়ে আবেগ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলো নিয়ে যারা সমালোচনা করছে, এখানে একটা রাজনীতি আছে। তারা সবাই পরাজিত শক্তির পক্ষে। ‘রিসেট বাটন’ নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন, তারা মনে করে যে একাত্তর-ই শুরু, একাত্তর-ই শেষ। অথবা, পঁচাত্তরের পর সব শেষ হয়ে গেছে। ‘বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশ হতো না’ দাবির পাশাপাশি সমালোচনাকারীরা এখন বলছেন যে ‘বাংলাদেশ একমাত্র নিরাপদ থাকে শেখ হাসিনার হাতে’- শেখ হাসিনা বিদায় হয়ে গেছে, এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না।’ একটু খেয়াল করলেই দেখবেন- মহিউদ্দিন সাহেবের এই বক্তব্যের মধ্যেও আবেগ লুকিয়ে আছে। সেটা হয়তো সবাই বুঝতে পারছেন না। রাজনীতিতে হার-জিৎ আছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তার মানে তাকে বা আওয়ামী লীগকে পরাজিত শক্তি বলা সমীচিন হবে না। কেননা, অনেক বছর এই দলটি দেশ শাসন করেছে। এই দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে দলটির গৌরবের ঐতিহ্য রয়েছে। সেটাকে কেউ মুখের কথা মুছে ফেলতে পারবে না। আর কেউ যদি সে-ই চেষ্টা করে; তাহলে সেটা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা।
কয়েক দিন ধরেই ফেসবুকে ‘রিসেট বাটন’ শব্দ দু’টো ফেসবুক সার্চে ‘পপুলার নাউ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই তাদের ফেসবুক পোস্টে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে লিখছেন ‘স্টেপ ডাউন ইউনূস’। অর্থাৎ, ‘ইউনূসকে হটাও’। টুইটারে যে হ্যাশট্যাগগুলো ট্রেন্ড করছে, এটি সেগুলোর মাঝে অন্যতম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ ছিল ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’ অর্থাৎ হাসিনা হটাও। ‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন কটাক্ষ করে প্রশ্ন করেছেন, ‘রিসেট বাটনে চাপ দিলে নোবেল পুরষ্কারের কী হবে?’ তিনি মূলত মুহাম্মদ ইউনূসকে কটাক্ষ করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এবং তিনি যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। অতীত মুছে ফেলা প্রসঙ্গে আবু সাঈদ নামক একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীও মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত অর্জন ও পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ‘ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্ম, শেখ হাসিনা সরকারের সকল অতীত কর্মকাণ্ড’ মুছে গেছে কি নাÑ এই প্রশ্নও রাখেন তিনি। যদিও তার ওই পোস্টে আদনান এইচ খান নামক একজন লিখেছেন, ‘এটি স্রেফ একটি উপমা।’ এমন আরও অনেকেই ফেসবুক ও টুইটারে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস ওই সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সাল তথা বাংলাদেশ গঠনের ইতিহাসকে অস্বীকার করে কথা বলেছেন। এ সব কথায় স্পষ্ট নেটিজেনরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তবে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন রিসেট বাটন চাপার কথা বলেছেন, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি থেকে নতুনভাবে শুরু করার কথা; যা বাংলাদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষের ভোটের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছে। বাংলাদেশের গৌরবের ইতিহাসকে মুছে ফেলার কথা তিনি বোঝাননি। যখন আপনি রিসেট বাটন চাপবেন, তখন সফটওয়্যার আবার নতুন করে চালু হয়। সেটা হার্ডওয়্যারের কোনো পরিবর্তন করে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার তৈরি হয়েছিল। ভয়েস অব আমেরিকাকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু মানুষ ভুল ব্যাখ্যা করছে। প্রেস সচিবের এই বক্তব্যের পরও সমালোচনা থামছে না। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে হার্ডওয়্যার বললেও অনেকে বলছেন সফটওয়্যার। কেউ কেউ বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সফটওয়্যারকে একেক সময় একেকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিতে গত ৮ আগস্ট ঢাকায় পৌঁছানোর পর মুহাম্মদ ইউনূস শাহজালাল বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৭১ সালে গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তার এই বক্তব্যেরও কম সমালোচনা হয়নি। নেটিজেনদের অনেকেরই প্রশ্ন- দ্বিতীয় স্বাধীনতা মানে কী? একটি দেশ একবারই স্বাধীন হয়। এদেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি মনে- অহেতুক কোনো বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করা ঠিক না। ড. ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তার বক্তব্যে মানুষের কাছে ভুল মেসেজ যেতে পারে। এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদেরও মনে রাখতে হবেÑ চাইলে ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন