রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মারামারি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া মাদকদ্রব্য মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রি হয় অনেকটা প্রকাশ্যে। এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে দুইজন খুন হয়েছেন। শনিবার রাতে স্থানীয় সন্ত্রাসী রিপন ফকির ও তার সহযোগীরা যৌনপল্লীর আলেয়া গেটে ফারুক সরদার (২৬) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের বিরোধে তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে ৭ অক্টোবর সুমি আক্তার মিতা (৩১) নামে এক যৌনকর্মী তার নিজ ঘরে খুন হন। এই দুই ঘটনায় যৌনপল্লীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
নিহত ফারুক দৌলতদিয়া ইউনিয়নের সোহরাব মণ্ডলপাড়ার পল্লী চিকিৎসক শহিদ সরদারের ছেলে। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ফারুকের বন্ধু আলামিন (২১) নামে আরেক যুবক। সে দৌলতদিয়া শামসু মাস্টার পাড়ার আব্দুস সালামের ছেলে। ফারুক হত্যায় হুমায়ুন (২৫) নামের এক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। হামলাকারী রিপন দৌলতদিয়া ইউনিয়নের আইনদ্দিন বেপারি পাড়ার রমজান ফকিরের ছেলে।
নিহত ফারুকের ভাই মনিরুজ্জামান জানান, দুর্গাপূজা উপলক্ষে পূজা শুরুর দিন থেকে দৌলতদিয়া রেলস্টেশনের পাশে মেলা বসেছে। ওই মেলায় জুয়ার আসর বসায় স্থানীয় রিপন ও তার সহযোগীরা। মেলার বিভিন্ন দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদাও তুলছিলেন তারা। জুয়ার আসর বসানো এবং চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করে আসছিল ফারুক। শনিবার রাত ৯টার দিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে রিপনের মুদিদোকানে গিয়ে আবারও রিপনকে চাঁদাবাজি ও জুয়ার আসর বন্ধ করতে বলেন ফারুক। এ সময় রিপন ও তার সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফারুকের মাথায়, পিঠে, পায়ে ও হাতে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে প্রথমে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ফারুককে মৃত ঘোষণা করেন।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) শরীফ আল রাজীব বলেন, ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযুক্ত রিপনসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দুর্গা পূজার মেলায় জুয়া ও চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ফারুক ও রিপনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে চর এলাকার মাটি ও বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিরোধ ছিল এ সকল দ্বন্দ্বের জেরে দুদিন আগে দুগ্রুপে মারামারি হয়। শনিবার রাতে ফারুক ৪-৫ বন্ধু নিয়ে ১ নং গেট দিয়ে যৌন পল্লীর ভেতরে রিপনকে (৩০) খুঁজতে ছুটে যায়। এসময় ফারুকের বাবা তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। রিপনের দোকানে গিয়ে ফারুক তার ওপর চড়াও হন। এক পর্যায় রিপন পাশে থাকা ডাব কাটার দা দিয়ে ফারুককে কোপায়। নিহত ফারুক ও হামলাকারী রিপন উভয়ই মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মুহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম জানান, রিপন ও ফারুক গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। তিনদিন আগে দৌলতদিয়া শহীদ মিনার এলাকায় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
জানা গেছে, রিপন ফকিরের বাবা রমজান ফকিরের আদিনিবাস পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী এলাকায়। বহু বছর আগে তিনি দৌলতদিয়ায় আসেন পেটের তাগিদে। এসেই জড়িয়ে পড়েন অপকর্মে। যৌনপল্লীর সাথী বাড়িওয়ালির সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে। একটি মামলায় তার সাজা হয়েছে বলে জানা গেছে। রমজান ফকিরের দৌলতদিয়া রেল স্টেশনে একটি বোর্ডিং রয়েছে। রাতে সেখানে যৌনকর্মীরা দেহব্যবসা করে। এছাড়া যৌনপল্লীর ভেতরে রমজান ফকিরের বাড়ি রয়েছে। সেখানে ছুকরি (অপ্রাপ্ত বয়স্ক যৌনকর্মী) দিয়ে ব্যবসা চালানো হয়। আগে এই ছুকরির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন নারী নেত্রী ঝুমুর বেগম। সরকার পতনের পর তিনি পালিয়ে যান। এরপর এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় রিপন ফকির। তিনি দৌলতদিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি মোহন মণ্ডলের ভাতিজি জামাই। মোহন মণ্ডল এখন বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দৌলতদিয়া ঘাট তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দের কয়েকজন নেতা তাকে সমর্থন দেন বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। তার প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে রিপন ফকির। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন বাড়ি ও মদের দোকান থেকে সে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করতো বলে জানা গেছে। তার আরেক ভাই মোমিন ফকিরও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। তাদের আরেক চাচা হাসেম ফকির ও মহির উদ্দিন ফকিরেরও যৌনপল্লীতে বাড়ি রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পুরো পরিবারই বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত।
যৌনকর্মীকে শ্বাসরোধে হত্যা : দৌলতদিয়া যৌনপল্লী থেকে সুমি আক্তার মিতা (৩১) নামে এক যৌনকর্মীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৭ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে দবির সরদারের বাড়ির দোতলা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আগের রাতে নিজ কক্ষে তাকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। তার চার বছরের এক শিশুসন্তান আছে।
জানা গেছে, সুমি রাত ১১টার দিকে পাশের বাড়ির একটি পার্টিতে অংশ নেন। সেখান থেকে ফিরে রাত দেড়টার দিকে এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে নিজ ঘরে যান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই বাড়ির বুয়া দোতলায় কাপড় শুকাতে গিয়ে দেখেন সুমির কক্ষের দরজা খোলা। খাটের ওপর ছোট গামছা দিয়ে মুখ আটকে আরেক কাপড় দিয়ে মাথার চুল পেছন থেকে বাঁধা রয়েছে। এ ছাড়া দুই হাত, দুই পা ও কাপড় দিয়ে ঘরের জানালার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। পরে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। ওই ঘটনার পর থেকে যৌনপল্লীতে খদ্দের কমে যায়। এরপর ফারুক খুনের ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
ভোরের আকাশ/ সু