logo
আপডেট : ১৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:১৮
চড়া সুদ হারে ব্যবসা স্থবির
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

চড়া সুদ হারে ব্যবসা স্থবির

পাশাক খাতের রপ্তানিমুখী কোম্পানি শাশা ডেনিমস ব্যবসা বাড়াতে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ২১০টি নতুন লুমের একটি কারখানা তৈরির চেষ্টা করছিল; পরিকল্পনা ছিল এর মাধ্যমে আরও প্রায় সোয়া কোটি ডলারের আয় বাড়ানো। বছরে পৌনে তিন কোটির বেশি ইয়ার্ড তৈরিতে সক্ষম শাশা ডেনিমস এটি ছাড়াও সহযোগী কোম্পানি হিসেবে আরও একটি পোশাক কারখানায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার টার্নওভার বাড়বে এবং দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে তাদের আশা ছিল। তবে বাড়তে থাকা সুদহার বাধ সেধেছে শতভাগ রপ্তানিমুখী ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির পরিকল্পনায়।

শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, নতুন এসব কারখানায় ও ব্যবসার প্রসারে আমাদের ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি। ঋণ নিয়ে তারপর উচ্চ হারে সুদ দিয়ে ব্যবসা ‘ভায়াবল’ করা সম্ভব না। ব্যবসা সম্প্রসারণের বড় ওই পরিকল্পনা কাটছাঁট করে এখন শুধু ১৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, যেটা না করলেই নয়, করতেই হবে। আমরা কেবল সেই বিনিয়োগটাই করছি।

পোশাক খাতের অন্যতম বড় কোম্পানি শাশা ডেনিমসের তিনটি ডাইং ইউনিটে বর্তমানে এক হাজার ৬০০ কর্মী কাজ করছে। সর্বশেষ জাতীয় রপ্তানি ট্রফি পাওয়া এ কোম্পানির বার্ষিক আয় ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৮৮ কোটি টাকা। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে মাঝপথে সরে আসার সিদ্ধান্ত শুধু শাসা ডেনিমসের একার নয়; বৃহৎ শিল্প থেকে শুরু করে দেশের প্রান্তিক পর্যারে উদ্যোক্তারাও এমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও প্রায় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। উচ্চ সুদহারের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যে শুধু বাধা তৈরি করছে তা নয়, সমস্যার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় এর সরাসরি আঘাত পড়ছে কর্মসংস্থান তৈরিতে। ‘সংকট’ বাড়ছে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে। এর ধাক্কা লাগছে কর্মহীন হয়ে পড়া বা উচ্চমূল্যের বাজারে খাপ খাওয়াতে না পারা কম বা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর।

দেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে গেল দুই বছর ধরে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দশা শুরু হয় মূলত মহামারির সময় বিশ্ব অর্থনীতি পুরো স্থবির হয়ে পড়লে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে তেলের বাজার এবং ডলারের বিনিময় হার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে অর্থনীতির বিপদ আরো বাড়ে। সব মিলিয়েই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে তখন টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমা অর্থনীতি ধীর হয়ে পড়ায় পোশাকের বাজারে রপ্তানি আদেশ কমছিল। আর আমদানি খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছিল দেশের মানুষ। ওই পরিস্থিতিতেও ডলারের বিনিময় হার প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয়নি। অর্থনীতির বিশ্লেষকদের তরফে নীতি সুদহার বাড়ানো এবং ব্যাংকের সুদের হার বাজারের ওপর ছাড়ার পরামর্শের পরও নয়-ছয় সুদহার পদ্ধতি বহাল রাখা হয়। পরে ২০২৩ সালে আইএমএফের চাপে নয়-ছয় ব্যবস্থা তুলে নিয়ে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এরসঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো সুদহার বাড়ানো শুরু হলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সুদের হার। চাপে পড়তে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। পণ্য আমদানিও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার দুই মাসে দুইবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। একবছর আগে ঋণের সুদ হার যেখানে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে ছিল, এখন তা পৌঁছে গেছে ১৪ শতাংশে। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য নিয়ে রেপো হার বাড়ানো হচ্ছে, সেই মূল্যস্ফীতি এখনও রয়ে গেছে দুই অঙ্কের কাছাকাছি, ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম সূচক হচ্ছে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত জুলাই ও অগাস্টে ১০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। ওই বছরের জুলাই-আগস্টে এলসি খোলা হয়েছিল ১১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের। আবার ওই দুই মাসে ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানির এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ কম নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ; আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে জুনে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর, যিনি আগে থেকেই সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলে আসছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পর সে পথেই হেঁটেছেন তিনি; প্রথমে ২৫ আগস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার করেন ৯ শতাংশ। পরের মাসে এটি আবার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করেন। আগের সরকার চলতি বছরের জানুয়ারিতে একবার ২৫ বেসিস পয়েন্ট এবং মে মাসে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ায় রোপো হার। স্বল্প সময়ের মধ্যে চার দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ব্যাংকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার বেড়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছায়।

শাসা ডেনিমসের এমডি শামস মাহমুদ বলেন, ইন্টারেস্ট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘কন্ট্রাকডরি’। এটাও একটি মাধ্যম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের, কিন্তু দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি ডিজাস্টারাস মেজার। বিশ্ব বাজারে শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এর ফলে বরং জিনিসের দাম আরও বেড়ে গেছে। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন নিয়ে ব্যবসা ভায়াবল করা সম্ভব না। আমরা হয়ত কিছু সময় পেমেন্ট ডেফার করে এটি কাটাতে পারব। কিন্তু এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ইউরোপের বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এই ইনভেস্টমেন্টের টাকা কোথা থেকে আসবে?

ব্যাংক ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে পৌঁছে যাওয়ায় ব্যবসার খরচ বাড়বে ও মুনাফায় প্রভাব ফেলবে বলে গত শনিবার এক সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, এমন দেশ নেই যেখানে ব্যবসায়ীরা দুই অঙ্কের ব্যাংক সুদহারে মুনাফা করতে পারেন। দেশে এখন সুদের হার ১৪ শতাংশ। তার ভাষ্য, এর ফলে এই মুহূর্তে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। অথচ বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে পণ্যের মান, ভাবমূর্তি ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ সুদহারের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, প্রকৃত সুদের হার ১৪ শতাংশেরও বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার পর সুদের হার প্রথম বাড়ে। মীর নাসিরের মতে, আইএমএফের ঋণ প্রকারান্তরে দেশের ওপর ‘ক্ষতিকর প্রভাব’ ফেলে। সেটা ব্যবসায়ীদের উপকারে আসে না। তিনি বলেন, ৯ ছিল, এখন ১৪-১৫ শতাংশ হয়েছে। এটা আরও বাড়তে পারে এবং এটি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। এটি অনেক হাই। কোন শিল্প, কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এটা অ্যাডজাস্ট করে টিকে থাকতে পারে?

ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। ক্রেতাদের টাকাও মিলছে নাÑ এমন প্রেক্ষাপটে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের। ব্যাংকের পেশা ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া মো. গাজী তৌহিদুর রহমান বললেন, ব্যাংকের এই মুহূর্তে ডিপোজিট নাই, তারা লোন দেবে কীভাবে?

নরসিংদীতে বড় কারখানা রয়েছে জাতীয় এসএমই পুরস্কার পাওয়া তৌহিদের। ২০০ জনের বেশি কর্মী সেখানে কাজ করেন। কামরাঙ্গীর চরেও তার ডিসপোজেবল প্লাস্টিকের কারখানা রয়েছে। বর্তমানে তার কোম্পানির ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা। প্লাস্টিকের লিব্লস্টার প্যাকেজিং, মোবাইলের ব্যাটারি, চার্জার, মাজুনির কভার বানানো এফএমপ্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির কর্ণধার তৌহিদ বলেন, এখন সমস্যাই হচ্ছে লোন পাওয়া। ক্রেতারা যেসব ব্যাংকে টাকা দিচ্ছেন, তুলতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে তোলা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো সিক। কাস্টমার টাকা ঢুকাইছে, টাকা উঠাতে পারছে না।

লব্লক প্রিন্ট ও কটন কাপড়ের ভিন্ন-ধারার পোশাক বাজারে নিয়ে আসা ফার্স্ট ফ্যাশন স্টার্টআপ ‘অরাম বাংলাদেশ’ এর প্রধান কর্মকর্তা নিশাত আনজুমের কণ্ঠেও একই সুর। তিনি বলেন, এখন ব্যাংক থেকে টাকাই পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এসএমই খাতে স্বল্প ঋণের সুদ থাকলেও সেই স্কিম সবসময় থাকে না। তখন সুদ চলে যাচ্ছে ১৪ শতাংশে। এত সুদ দিয়ে এখন প্রফিট হবে? ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রথমেই ধাক্কা খেতে হচ্ছে। তাছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যেসব বাড়তি কাগজ, নথি আর ব্যাংক স্টেটমেন্ট লাগে, এটাও ‘বড় হ্যাসেল’ বলে তার অভিযোগ। নিশাতের ভাষ্য, ব্যাংক ঋণে অনেক ‘লুকানো শর্ত’ থাকে। দেখা যায়, কেবল সুদ দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে, আসল থেকে সুদ বেশি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আসল শুরুই হচ্ছে না। পরে জামানত রাখা সম্পদ নিলামে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এতসব তথ্য জানা থাকে না। ফলে এত সুদ দিয়ে ব্যবসা করা যাচ্ছে না। বন্ধু ও পরিবারের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। তাতে বড় বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। ক্লোদিং ব্যবসার পাশাপাশি কৃষি পণ্যেও বিনিয়োগের ইচ্ছে রয়েছে এ তরুণ নারী উদ্যোক্তার। কিন্তু সে জন্য অনুকূল পরিবেশ তিনি দেখছেন না।
‘আগে কাস্টমার ব্যাংক খুঁজত কে লোন দেয়, এখন ব্যাংক কাস্টমার খোঁজে,’ এভাবেই বর্তমানের চিত্র তুলে ধরলেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের উপ-শাখা ইনচার্জ। বাড়তি সুদহারের কারণে শেষের এক বছরে এ উপশাখার ঋণ প্রবৃদ্ধি ‘৮০ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে’ বলে তার ভাষ্য। ওই ব্যাংকার বললেন, কী বলব ভাই। আজও এক কাস্টমার এখান থেকে একটু কম পাওয়ায় আরেক ব্যাংকে টেকওভার করছে।

নতুন গভর্নর এসে হঠাৎ ক্লাসিফায়েড ঋণের ক্ষেত্রে নয়টি ‘ওভারডিউ’ থেকে ছয়টি ‘ওভারডিউ’ করায় ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। বেড়েছে ক্লাসিফায়েড লোনের পরিমাণ। ‘এক প্রান্তিকের ব্যবধানে ক্লাসিফায়েড লোন ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ হয়েছে। ওভারডিউ হচ্ছে, বকেয়া থাকে কিন্তু খারাপ লোন না। এর থেকে ব্যাংক আয়ও করতে পারে। ওই সিদ্ধান্তে একমাসেই এ অবস্থা হয়েছে। ব্যাংক এখন সুদহারে ছাড় দেবে কীভাবে,’ প্রশ্ন করেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। আরেক ব্যাংকার বলেন, অনেক বিজনেসম্যান মার্কেটে টাকা খাটানোর বদলে ফিক্সড ডিপোজিট করতে চাচ্ছে। এছাড়া যাদের ঋণ নেয়া ছাড়া উপায় নেই, তারা নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আল্টিমেটলি রিটেল গ্রাহকের ওপরই প্রভাব পড়ছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকে ঋণ বাতিল করেছে বলেও জানান তিনি।

শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস বলেন, বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখন ভালো নয়। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এটা দ্রুত সমাধান না করা গেলে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা হারাবে। তিনি বরং চাঁদাবাজি বন্ধ করে, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও আমলাতন্ত্রের সমস্যা দূর করে মূল্যস্ফীতি কমানো ও ব্যবসার পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির বলেন, উচ্চ সুদহার দ্রুতই অ্যাড্রেস করা উচিত। নয়ত ঋণখেলাপি বাড়বে। কেউ অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। অনেকদিন ধরেই ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও পণ্যমূল্য বাড়ায় ব্যবসা সংকটে ছিল। সুদের হার বেড়ে এখন ‘অসহনীয়’ হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য ভিন্ন চিন্তার কথা বলেছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। সুদের হার কমিয়ে অন্য উপায়ে মূল্যস্ফীতি কমানো যায় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চাঁদাবাজি কমিয়ে হয়ত কিছু জায়গায় মূল্য কমানো যাবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি যেখানে বিরাজ করছে, সেখানে মুদ্রানীতি টাইট না হলে আগুনে ঘি ঢালা হবে।

‘সস্তায়’ ঋণ না চেয়ে ব্যবসার মডিউল পরিবর্তন ও ব্যবসায় খরচ বাড়ার অন্য যেসব কারণ আছে, যমেন কর, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, এনবিআরের সংস্কার, বন্দর ও আরজেএসসির সংস্কারে ব্যবসায়ী নেতাদের সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতির এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, এই সমস্যা সারা পৃথিবী ফেস করেছে মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে। অনেকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতেও পেরেছে। আমাদের তো তাদের থেকে শিখতে হবে। কিন্তু আমরা হেঁটেছি উল্টো পথে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হার বাড়ছে। এর আগে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে সুবিধা দেয়া হয়েছে। উচ্চ সুদহারে ঋণখেলাপি বাড়াবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবাই স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ দেখে। দেশের স্বার্থ, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ দেখে না। সুদ হারের কারণে তাদের (ব্যবসায়ীদের) সমস্যা হচ্ছে ঠিক, কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের রেভিনিউও বেড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশনা একদম স্পষ্ট। যতক্ষণ মূল্যস্ফীতি সিংগেল ডিজিটে না নামবে ততক্ষণ নীতি সুদহার বাড়তে থাকবে এবং আমরা দেখেছি, এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমেও আসছে। ফুড ইনফ্লেশন বাদে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পণ্যের উচ্চমূল্যে ‘হিমশিম’ অবস্থা হলেও আন্দোলন, সংঘাত, বন্যা ও ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট অস্থিরতার ধাক্কা কাটিয়ে জুলাই-আগস্টের পর দুই অংকের নীচে নেমে এসেছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ব্যবসা পরিস্থিতির ‘স্থবিরতা’ নিয়ে হুসনে আরা শিখা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পজিশন হচ্ছে, ব্যাংক ঋণ অনেক কস্টলিয়ার হবে। এটি আরও বাড়তে পারে। এতে সাময়িক সময়ের জন্য তাদের (ব্যবসায়ীদের) অসুবিধা হবে। কিন্তু পার্মানেন্টলি মূল্যস্ফীতি কমে এলে আবার ৬-৯ এ নেমে আসবে।

 

ভোরের আকাশ/রন