logo
আপডেট : ১৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:৪৩
সেই ১২০ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কোথায় 
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

সেই ১২০ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কোথায় 

চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে দেশের ইতিহাসের অন্যতম উত্তাল সময় পার করেছে জনগণ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে অভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে, যার মাধ্যমে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। তবে এর আগে আন্দোলন দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করতে দেখা যায় সরকারদলীয় তৃণমূল নেতাকর্মী ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদেরও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১২ জেলায়। অন্য জেলাগুলো হলোÑ চট্টগ্রাম, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, জামালপুর, হবিগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট ও লক্ষ্মীপুর।

সরকার পতনের পর বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ ১২টি জেলায় ১২৬ জন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে, এদের মধ্যে বড় অংশই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়া ১০ জন অস্ত্রধারীর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনজনকে। ফেনীতে শনাক্ত হওয়া ৩৩ জন অস্ত্রধারীর মধ্যে একজনকে, কেরানীগঞ্জে চারজনের মধ্যে একজনকে এবং সিরাজগঞ্জে দুজনের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার এ ছয়জনের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। অবশ্য অস্ত্রধারীদের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয়া বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অবশ্য শনাক্ত হওয়া অস্ত্রধারীদের ধরতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। অনেকেই নজরদারিতে আছেন। তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

আলোচিত ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি ফুটেজে দেখা যায়, ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে অস্ত্র হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছেন এক যুবক। পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওই যুবক ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাতিজা। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল। সেদিন আসিফের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়েছিলেন।

একইদিন এ রকম আরেকটি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে, যেটি মোহাম্মদপুরের। সেদিন মোহাম্মদপুরের বছিলা সড়কেও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়া হয়েছিল। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আরেকজন সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব এবং সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান ওরফে বিপ্লব আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের মাঝা-মাঝি থেকে আগস্টের শুরুতে রাজধানীর যেসব এলাকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর। এরমধ্যে ১৭-২১ জুলাই এবং ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা পর্যন্ত সড়কে অবস্থানকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করা হয়েছিল। আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মোহাম্মদপুর এলাকায় দলবল নিয়ে সক্রিয় ছিলেন সাবেক দুই কাউন্সিলর আসিফ ও রাজীব এবং বিপ্লব। গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর আত্মগোপনে চলে যান তারা। এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকেও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমন ১০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, যারা সবাই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মী। চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবরকে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত তিনি। এছাড়া যুবলীগের কর্মী মো. তৌহিদ ও মো. ফিরোজকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে। ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী মো. দেলোয়ারও।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই মাসে শত শত মামলা হয়েছে, পুলিশ ও প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রদবদল হয়েছে; এরপরও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি কেন, জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, থানায় হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মাঝখানে অভিযান চালানো যায়নি। এই সুযোগে অস্ত্রধারীদের বেশিরভাগই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এখন অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিও ফুটেজে ফেনী শহরের মহিপাল এলাকায় একে-৪৭-এর মতো দেখতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার চোখে পড়েছে। সরকার পতনের আগের দিন, গত ৪ আগস্ট ওই ভিডিওটি ধারণ করা হয়। সেদিন গুলিতে মহিপালে চার শিক্ষার্থীসহ ৯ জন নিহত হন।

ভিডিও ফুটেজে যাদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তাদের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং ফেনী সদরের কাজীরবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ।

মহিপাল এলাকা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ৪ আগস্ট মহিপালে অন্তত ৩৩ জনের হাতে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা সবাই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর অনুসারী। তবে ৩৩ জন অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা গেলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র একজন। তিনি হলেন ফেনী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি ওরফে লিটন। ইতোমধ্যে দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন সময় (১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) নারায়ণগঞ্জে যেসব অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, শামীমের শ্যালক তানভীর আহমেদ এবং শামীমের ঘনিষ্ঠ শাহ নিজাম আছেন। যদিও তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের কেউই তাদের অস্ত্র জমা দেননি। ফরিদপুরে যারা অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ৩৩ জনের পরিচয় জানা গেছে। এর মধ্যে ফরিদপুর পৌরসভার তিনজন সাবেক কাউন্সিলর রয়েছেন। তারা হলেন মোবারক খলিফা, আবদুল হক ও গোলাম মো. নাসির। এ ছাড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামিদুল রশিদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়াউল হাসান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ মো. সুলতানকেও অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে। তবে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন ও গুলি ছোড়ার ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান বলেন, অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি।

সরকার পতনের আগের দিন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সামনে অস্ত্রধারীদের গুলিতে প্রাণ হারান দুজন, সঙ্গে আহত হন বেশ কয়েকজন। সূত্র বলছে, সেদিন অন্তত ১২ জন অস্ত্রধারী হামলায় অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য আবু জাহিরের নেতৃত্বে। এছাড়া সিলেটে ১২ জন, জামালপুরে তিনজন, সাভারে দুজন এবং রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর ও রংপুরে একজন করে অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা হলেও সবাই আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একইভাবে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি রাজধানীর ঘটনাগুলোয় শনাক্ত অস্ত্রধারীকেও। যেমন গত ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় অংশ নেন মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম জাহিদ। তিনি যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি। এর বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ২ আগস্ট উত্তরার জমজম টাওয়ার এলাকায় অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা যায় ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেনকে। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন অস্ত্রধারী। ৪ আগস্ট উত্তরার আজমপুর এলাকায় অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুরতাফা বিন ওমরকে। এছাড়া গত ১৬ জুলাই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হাসান মোল্লাকে অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায়নি।

 

ভোরের আকাশ/রন