logo
আপডেট : ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৩৬
আজ বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অবহেলা নয়
ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অবহেলা নয়

আজ বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর অধিকার নিয়ে কাজ করে বিশ্বের এমন বিভিন্ন সংস্থা নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করছে। ১৯৬৪ সাল থেকে প্রতিবছরের ১৫ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত নির্দেশনা এবং জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদে (UNCRPD) অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে সরকারের পক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করে বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্তকরণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকে। সরকারি উদ্যোগে দেশে শোভাযাত্রা, আলোচনাসভা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেধাবী শিক্ষার্থীদের এ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এককালীন অনুদান প্রদানসহ সারা দেশে ৬৪ জেলায় আলোচনাসভা ও স্মার্ট সাদাছড়ি বিতরণ করা হয়ে থাকে। লায়নস ইন্টারন্যাশনালের হিসাব মতে, বিশ্বে দুই কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ পুরোপুরি ও আংশিকভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৪ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ হিসাবে দেশে বর্তমানে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৪৭.৪২ লাখ। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ০.৩৯ শতাংশ বা ১৬ লাখ ২৫ হাজার। এসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের নিরাপদে সড়ক ও অন্যান্য স্থানে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার প্রতীক হিসেবে সাদাছড়ি ব্যবহার করা হয়।

এতে যারা চোখে দেখে তারা তাদের চলাচলে সহযোগিতা করে। তাই বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিশেষত শিশু শিক্ষা এবং পরবর্তী জীবনধারায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটি খুবই তাৎপর্য বহন করে।

শিক্ষা হলো শিশুর উন্নয়নমূলক পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যার দ্বারা শিশু তার পরবর্তী জীবনধারায় পরিবেশের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সংগতি বিধান রেখে সমাজজীবনে চলতে সক্ষম হয়। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে ‘শিক্ষা মানেই জীবন আর জীবন মানেই শিক্ষা।

বর্তমানে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের চাহিদা, দক্ষতা, ক্ষমতা ও অনুরাগ অনুযায়ী যে শিখন-শেখানোর কথা বলা হয়ে থাকে, যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়ে থাকে তার পেছনে রয়েছে শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে নিত্যনতুন গবেষণায় প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত। দেশে বর্তমানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। যথা—একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা। দেশে প্রথম ১৯৭৪ সালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। প্রতিটি কার্যক্রমে একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘রিসোর্স শিক্ষক’-এর তত্ত্বাবধানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হয়ে থাকে। প্রতি জেলায় প্রতিটি কেন্দ্রে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্ধারিত আসনসংখ্যা রয়েছে ১০টি। এ হিসাবে দেশে ৬৪টি জেলায় মোট ৬৪০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু সম্পূর্ণ সরকারি খরচে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পড়াশোনা করছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে ঢাকার মিরপুর, খুলনার গোয়ালখালী, চট্টগ্রামের মুরাদপুর, রাজশাহী সদর এবং বরিশালের সাগরদীতে অবস্থিত। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এসব বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে প্রায় ২৫০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কারণ দেশে ২০২২ আদমশুমারি তথ্য মতে, প্রায় চার লাখের বেশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু (সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং ক্ষীণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) রয়েছে। এর মধ্যে যারা সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাদের জন্য বিদ্যমান সরকারি পাঁচটি বিশেষায়িত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ছাড়া সরকারিভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্কুল নেই, যেখানে অন্ধ বা সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুরা পড়াশোনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তি, বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বিশেষায়িত বিদ্যালয়গুলোর সরকারি স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ফলাফল এনে দিতে পারে।

দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের নিরাপদ চলাচলে প্রযুক্তি অগ্রসর ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবন্ধী বিশেষজ্ঞরা একটি সুনির্দিষ্ট গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের নিরাপদ চলাচলসহ সার্বিক উন্নয়নে ১৫টি সুপারিশ প্রণয়ন করেছেন। সুপারিশগুলোর মধ্যে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নতমানের সাদাছড়ি তৈরি, নামমাত্র মূল্যে সাদাছড়ি ব্যবহারকারীদের মধ্যে তা বিতরণ, সাদাছড়ি ব্যবহারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উৎসাহিত করতে এবং এর ব্যবহার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইমারত, রাস্তা, ফুটপাত, রেলওয়ে প্ল্যাটফরমসহ পাবলিক প্লেস দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উপযোগী করে তৈরি করা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বই ও অন্যান্য মুদ্রণ ডাক মাসুলমুক্ত প্রেরণ করার সরকারি নির্দেশ সম্পর্কে ডাক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অবহিত করা, ডাকঘর সঞ্চয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্কিম চালু, মোবাইল অপারেটরগুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে শতকরা ১ ভাগ কোটা চালু, পিএবিএক্সের উপযোগী টকিং সফটওয়্যারের ব্যবস্থা করা, অ্যানড্রয়েড বিজয় কি-বোর্ড প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করা, বিজয় শিশু শিক্ষা প্রতিবন্ধী শিশুদের উপযোগী করা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচলে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর সফটওয়্যার উদ্ভাবন উল্লেখযোগ্য।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন কিশোরগঞ্জ

 

ভোরের আকাশ/রন