ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তবে বাংলাদেশের আন্দোলন এবং এর পরিণতি সম্পর্কে ভারত আগেই বুঝতে পেরেছিল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছেন তিনি। গত শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কথা বলেন পিনাক রঞ্জন।
শেখ হাসিনা সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের সঙ্গেও দেশটির স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে এবং আমরা জ্বালানি সংযোগ, রেলপথ এবং পরিবহন সংযোগের উন্নয়ন করেছি। তিনি বলেন, সেখানে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন বয়কট করেছে। এরপর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক সংগঠন ও দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থি জামায়াত নেতাদের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলায় সাজা দেয়া হয়েছিল। এ ধরনের কিছু কার্যকলাপের ফলে শেখ হাসিনা ক্রমশ বিতর্কিত হয়ে উঠেন। সেসব কাজে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পিনাক রঞ্জন বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সঙ্গে ভারতের সমস্যা ছিল নিরাপত্তা ইস্যু এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সঙ্গে তাদের মিত্রতা। বিএনপি বরাবরই একটু ডানপন্থি। জামায়াত অবশ্যই সবসময় পাকিস্তানপন্থি ছিল, যদিও তারা এখন দাবি করে যে তারা আলাদা। বিএনপিও দাবি করে, তারা বদলে গেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি বলেছিলেন, তারা তাদের মাটি ভারতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে দেবেন না। তার সময়ে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা) এর বিদ্রোহী নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে বিদ্রোহীদের শিবির ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং তাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিক দিয়ে শেখ হাসিনা আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পিনাক রঞ্জন বলেন, আমার মনে আছে কীভাবে শেখ হাসিনা আমাকে প্রথম বলেছিলেন যে তার ভারত থেকে বিদ্যুৎ দরকার। এভাবেই গ্রিড সংযোগের প্রকল্প শুরু হয়। আজ আমরা প্রায় ১,২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করি। আমরা ডিজেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহ করার জন্য উত্তর বাংলাদেশের নুমালিগড় শোধনাগার পাইপলাইনের পরিকল্পনাও করেছি। তিনি বলেন, আমি মনে করি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এবং জ্বালানি ও খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত লোকেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভবত ন্যায়সঙ্গত ছিল না। সৃষ্ট কর্মসংস্থান ছিল অপর্যাপ্ত এবং একটি তরুণ প্রজন্ম অর্থনীতিতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে। এ কারণে কোটাবিরোধী আন্দোলনে শুরু হয় কারণ কোটা সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থান তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছিল। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে নতুন ভোটাররা মনে করতেন যে তারা তাদের পছন্দ মতো নেতা পাচ্ছেন না। সেটাও ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা কোটা অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা বাতিল করার জন্য একটি সরকারি আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা তখন-এর বিরুদ্ধে আদালতে যায় এবং আদালত ওই আদেশ স্থগিত করে। তখনই আবার আন্দোলন শুরু হয়। তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এবার যখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় তখন আন্দোলন বন্ধ হয়ে যেত।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, কিন্তু ওই আন্দোলনে কয়েকশ মানুষ মারা যায়। পরে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলনকারীরা। তারা মন্ত্রী, পুলিশ কমিশনারসহ অনেকের পদত্যাগ চেয়েছিলেন। কেন তারা এমনটি করেছে তা একটি রহস্য। আমার মনে হয় সেখানে অন্যান্য প্রভাব ছিল যার বেশিরভাগ বিদেশি এবং কিছু অভ্যন্তরীণ। শেখ হাসিনা তখন তার মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে রাজি না হওয়ায় আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়। এই সময় আমি বুঝতে পারি যে পেছন থেকে শক্ত কেউ এর কলকাঠি নাড়ছে। তিনি বলেন, ঢাকায় পদযাত্রা ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি কীভাবে এতটা রাজনৈতিক হয়ে উঠল? এটাও একটা প্রশ্ন। ভারত কী এই বিষয়ে কিছু বুঝতে পেরেছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই, আমরা জানতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনা তার পতন প্রত্যাশিত করেছিলেন কিনা। আমার মনে হয় তিনি করেননি। সম্ভবত আপনি যখন ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকেন তখন আপনি অনুভব করবেন যে সবকিছু ঠিক আছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে তিনি বলেন, এটি বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। সেখানে রয়েছে উগ্র ডানপন্থি দল। এরপর আছে বিএনপির সহানুভূতিশীলরা। এরা সবাই সরকারকে বিভিন্ন দিকে টানতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদে দুইজন ছাত্রনেতা রয়েছেন এবং স্পষ্টতই প্রতি মন্ত্রণালয়ে দুইজন ছাত্র নিযুক্ত রয়েছেন তদারকি করার জন্য। তাই অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও আমার চিন্তা, তারা একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন কিনা?
ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, তিনি আগেও এখানে ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন, যখন তার পুরো পরিবারকে রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছিল। সে আবার ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, আমি বলব আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তারা এমন কোনো দল নয় যে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। শেখ হাসিনাকে মামলা এবং তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং তারা তাকে জেলে পাঠাতে পারে যেমনটা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি খুবই সম্ভব। আওয়ামী লীগে কী নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সম্ভাবনা আছে। তবে শেখ হাসিনা এখানে থাকবেন কিনা, সেটা তার পছন্দ। আমি মনে করি না যে ভারত সরকার তাকে বের করে দেবে।
ভোরের আকাশ/রন