logo
আপডেট : ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৩১
আ.লীগের ক্ষমতায় ফেরা কেন কঠিন
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

আ.লীগের ক্ষমতায় ফেরা কেন কঠিন

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একের পর এক টেলিফোন আলাপ ফাঁস হচ্ছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি টেলিফোন আলাপে দেখা যাচ্ছে যে তিনি আবারও ক্ষমতায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এবার ক্ষমতায় ফিরলে তিনি ‘রুল অব ল’ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে তার দলের এক কর্মীকে বলছেন। গতবার নানাজনের নানা তদবিরের কারণে তার পক্ষে ‘রুল অব ল’ বা আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি সেই বিষয়টিও আলাপে উঠে এসেছে।

ভারতে নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এই সরল স্বীকারোক্তি থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে তার শাসনামলে দেশে আইনের শাসন ছিল না। যেকোনও দেশের আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ওই দেশকে দোজখে পরিণত করে। বাংলার ইতিহাসের আলোচনায় বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ‘দোজখপুর নিয়ামত’ কথাটি বারবার ঘুরেফিরে আলোচিত হয়। তিনি মধ্যযুগের বাংলাকে দোজখপুর নিয়ামত বলে অভিহিত করেছেন। শেখ হাসিনার শাসনমালের বাংলাকেও ওই নামে অভিহিত করা যায়।

শেখ হাসিনার সময়ে উন্নয়ন হয়েছে এই কথা সত্য। পদ্ম সেতু ও মেট্রোরেল নির্মাণ শেখ হাসিনার বিরল কৃতিত্ব বলা যায়। উত্তরবঙ্গকে তিনি মঙ্গামুক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষের একটি অংশ একসময় ভাতের ফেন কচুঘেঁচু খেয়ে জীবন নির্বাহ করলেও তার সময়ে নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে সাধারণ মানুষ তিনবেলা দুই মুঠো ডাল-ভাত খাওয়া নিশ্চিত করতে পেরেছেন।

শেখ হাসিনা নিজেও ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ তার সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরো দেশকে ছুঁয়ে যায়নি। সুতরাং তার পক্ষে সহজে দেশের অর্থনীতির উন্নতি করা সম্ভব হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট এবং সর্বশেষ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি না হলে শেখ হাসিনার মজবুত অর্থনীতিতে ফুসকা ফেলানো কঠিন হতো। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে মাইলফলক স্থাপন করেছিলেন তা অটুট থাকতো। কিন্তু অর্থনৈতিক ওই উন্নয়ন সত্ত্বেও শেখ হাসিনা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। পাশাপাশি তার সময়ে দুর্নীতি শিখর থেকে শিকড়ে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তার একজন পিয়ন চারশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই উদাহরণ তার সময়ের দুর্নীতির প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তার সময়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের যত পাতি নেতা লক্ষ-কোটি টাকার মালিক হয়েছে তার সংখ্যা একেবারে কম নয়। কিন্তু তিনি তা জানতেন না এটা এক অবিশ্বাস্য বিষয় ছিল। তাহলে তাকে ঘিরে রাখা আমলাতন্ত্র যে তাকে শুধু জনবিচ্ছিন্ন করেনি; বরং তার নাম বিক্রি করে তারা শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে।

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পিয়নের চারশত টাকার দুর্নীতি তার জানার কথা ছিল। কিন্তু পিয়ন চারশত কোটি টাকার মালিক হওয়া পর কেন শেখ হাসিনা জানতে পারেন তা সত্যি বিস্ময়কর? ওই প্রশ্নের উত্তর তার খোঁজা দরকার। তার চারপাশ ঘিরে রাখা দলীয় নেতারা এবং গোয়েন্দা সংস্থা কেন তাকে প্রকৃত তথ্য দেয়নি তা অবিশ্বাস্য। শাসক হিসেবে শুধু তার পিয়নের দুর্নীতি নয়, রাষ্ট্রের সব স্তরের দুর্নীতি বন্ধ করা তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তিনি তা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর ওই ব্যর্থতা তাকে ক্ষমতাচ্যুতের পথে নিয়ে গেছে। তার উদাহরণ সৃষ্টিকারী উন্নয়ন শেষ পর্যন্ত জনগণকে ‘বেহেস্তি সুখ’ না দিয়ে দোজখের স্বাদ দিয়েছে। ফলে জনগণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে রাজপথে নেমেছে। অবশ্যই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওই রাজপথে নামা স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। জুলাই বিপ্লব বিশ্বের অন্য দেশে ঘটা বিপ্লবের মতো একটি ‘কালার বিপ্লব।’

জর্জিয়া, ইউক্রেন, কাজাগিস্তান, যুগোশ্লাভিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া অথবা শ্রীলংকার ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলোর মতো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবেও সুপার পাওয়ারের খেলা যে হয়নি সেটা এখনও প্রমাণ হয়নি। তবে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে শেষ দিকে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল তুঙ্গে। পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, আইনের শাসনের অভাব, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, একতরফা নির্বাচন ও রাষ্ট্রের নানা স্তরের বৈষম্যকে পুঁজি করে শেখ হাসিনার সরকারকে হটিয়ে দিতে চেয়েছে সাধারণ মানুষ। সেখানে বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলো অংশ নিয়েছে কি নেয়নি, সেটি হয়তো ভবিষ্যৎ গবেষণায় বের হয়ে আসবে। গবেষকদের এটি অবশ্যই বের করার সুযোগ আছে। কারণ অতীতে বিভিন্ন দেশে জনপরিসরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে পুঁজি করে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য তরুণদের মাধ্যমে সরকারের পতন হয়েছে; সেখানে সুপার পাওয়ারদের অংশগ্রহণ নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। তাই বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবেও এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা- সেটি নিকট কিংবা অদূর ভবিষ্যতে অবশ্য জানা যাবে।

যত পাওয়ারেরই খেলাই হোক, এসব সফল হতো না যদি দেশে আইনের শাসন থাকতো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতো। দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে জিরো টলারেন্স জারি থাকতো। নানা স্তরে বৈষম্যের অবসান শেখ হাসিনার সরকার করতে পারতো। তাই সুপার পাওয়ারকে বা বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রকে দায়ী করে শেখ হাসিনার সরকার নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করলে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য ফুটে উঠবে না। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে দুনীতি হয়েছে এবং আইনের শাসনের প্রবল অনুপস্থিতি ছিল- সেটিও স্বীকার করতে হবে।

নজির সৃষ্টিকারী উন্নয়ন সত্ত্বেও সাধারণ জনগণ কেন শেখ হাসিনাকে রক্ষায় এগিয়ে যায়নি? অথবা প্রকাশ্য বা নীরবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে কেন শেখ হাসিনার পতনকে ত্বরান্বিত করেছেন? উপর্যুক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলোয় তার শাসনামলের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া সাম্প্রতিক কথোপকথন থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। শুধু বিদেশি ষড়যন্ত্রকে দায়ী না করে আইনের শাসনের অভাব, দুর্নীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণগুলো শেখ হাসিনাকে যে ক্ষমতা থেকে ছিটকে ফেলেছে তা বোঝা দরকার সবার আগে।

ফেসবুকনির্ভর তরুণ প্রজন্ম সবসময় চেয়েছে প্রাণ খুলে কথা বলতে। কিন্তু সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে তরুণ প্রজন্ম প্রাণ খুলে ফেসবুকে লিখতে পারছিল না। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তাদের মনে। তারা প্রতিনিয়তই নানাভাবে ট্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ধরপাকড়ে পড়ছিল। ওই ভয়ের সংস্কৃতি এতটা জেঁকে বসেছিল যে তারা আড্ডায়ও মন খুলে কথা বলতে পারছিল না। ঘর ও বাহির কোথাও তারা স্বস্তিতে ছিল না। শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষের প্রায় সবাই নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছিল। একজন সেুলনের নাপিত আলাপে বলছিলেন, ‘তিনি সেলুনে চুল কাটার সময়ে সরকারের সমালোচনা করলে স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এসে তার ওপর চড়াও হতো। এখন তিনি মন খুলে কথা বলতে পারছেন। এজন্য তিনি খুশি।’ একজন স্বল্পশিক্ষিত নাপিতের ওই উপলব্ধিতে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময়ে ভয়ের সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণ কতটা ওষ্ঠাগত হয়েছিল তার বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। কিন্তু এর চেয়ে করুণ ও নির্মম কথা শুনতে হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রান্তের কর্মীদের মুখ থেকে। এমন একজন প্রান্তিক কর্মী বলছিলেন, তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। কিন্তু তাদের দলের সরকার চলে যাওয়ায় তিনি খুশি। কারণ হিসেবে তিনি বলছিলেন, তাদের নেতারা বিনা কারণে তাদের শুধু হয়রানি করতো তা নয়; বরং নানা হামলা-মামলা দিয়ে তাদের নিকট থেকে অর্থ আদায় করতো। এখন সরকার চলে যাওয়া মন খারাপ হলেও তার নিজের দলের নেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হবে না- সেটা ভেবে খুশি হয়েছেন।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিয়নের চারশত কোটি টাকার দুর্নীতির খবর যেমন জানতেন না, তেমনি তার প্রান্তের কর্মী-সমর্থকরা যে তার নিজ দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছে সেটিও নিশ্চিতভাবে জানতেন না। অথবা এখনও হয়তো জানেন না। কারণ আমলাতন্ত্রের মতো তার দলের নেতাতন্ত্রও প্রান্তের কর্মীদের দুর্দশার কথা তার কাছে লুকিয়েছে। শেখ হাসিনা কি আর কখনও রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন? এমন প্রশ্নের আগে ওই নেতাতন্ত্র ভাঙা দরকার সবার আগে। এবার বলি, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা পুনরায় রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন কিনা তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা যেমন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকাও আমলযোগ্য। আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল এবং বর্তমান ড. ইউনূস সরকারের অদক্ষতা ও ব্যর্থতাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ বলে যে কালার বিপ্লবে যেসব রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তারা আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেননি। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় না ফেরার ক্ষেত্রে ইতিহাসের ওই পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা তা সময় বলে দেবে। একইসঙ্গে তার রাজনীতিতে ফেরার বিষয়টিও সময়ের হাতে। ভারত এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে তা আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনের পর বলা যাবে। ততদিন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে অপেক্ষা করবে তা তাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে।

ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। ড. ইউনূস সরকারের ও বিপ্লবীদের প্রাথমিক ভারতবিরোধী তৎপরতায় ভারত যে রুষ্ট তা বলা যায়। তাদের বাংলাদেশে ভিসা কার্যক্রম সীমিত করা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালীন সময়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক না করা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বলা যায় ভারত এখনও তার বাজির ঘুঁটি শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের ওপর রেখেছে।

ইতিহাসের গতিপথে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার মিত্র রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হার্ড পাওয়ার ব্যবহার করেছে। ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান ঠেকাতে তারা ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ পরিচালনা করে। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফেরাতে তারা ‘হার্ড পাওয়ার’ নাকি ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহার করবে তা সময়েই বলে দেবে। তবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের উত্থান ও ভারতবিরোধীদের বাড়বাড়ন্ত ভারতকে হার্ড পাওয়ার ব্যবহারে বাধ্য করলেও অবাক হাবার কিছু থাকবে না। ভারতের ওই হার্ড পাওয়ার বা সফট পাওয়ার ব্যবহারের ওপরও শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফেরা নির্ভর করছে। যদিও অন্য রাষ্ট্রের ওপর ভর করে একটি রাষ্ট্রের অন্যতম রাজনীতিবিদের রাজনীতিতে ফেরার ঘটনা খুব একটা ভালো বার্তা আনবে না।

অন্য বিকল্প হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজপথে নেমে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জুলাই বিপ্লবের মতো নতুন কোনও বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফের পুনর্বহাল করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই ধরনের কোনও ঘটনা বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না। বিপ্লবীরা এবং আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা রাজপথে নামলে মুখোমুখি হলে পুনরায় রক্ত ঝরবে। হাজারও মায়ের বুক খালি হবে। তাহলে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে কিংবা ক্ষমতায় ফেরার বিকল্প কী? শেখ হাসিনা বা তার দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার একমাত্র বিকল্প হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও তার মাধ্যমে জনগণ চাইলে ক্ষমতায় আসা। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে জনপরিসর বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এবং তারা ওই নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। বর্তমান সরকার ওই নির্বাচন আয়োজন করলে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। শেখ হাসিনা ও তার দলের জনপ্রিয়তা প্রকৃতপক্ষে ২০০৮ সালের পর আর যাচাই করা যায়নি। আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা তা যাচাই করে দেখতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ চাইলে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় ফিরলে তখন কারোর কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।

শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনই কেবল বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব যাই-ই হোক না কেন দেশের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে না। মায়ের বুক খালি হলে তার দায়ভার বহন করা কারোর পক্ষেই সহজ হবে না।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে আইনের শাসনের ক্ষেত্রে, জনপ্রশাসনে, নির্বাচনি ব্যবস্থায় যে জঞ্জাল জমেছে তা পরিষ্কার করা দরকার। সব ক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করা দরকার। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সংস্কার একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। দরকারি বিষয়। আশা করি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবাই উপর্যুক্ত বাস্তবতা স্বীকার করবেন। বুঝতে পারবেন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের প্রয়োজনে যদি ওই সংস্কার প্রকল্পগুলো করতে চায় তাহলে দেশের সামগ্রিক মঙ্গলের স্বার্থে আওয়ামী লীগেরও উচিত তাদের সময় দেওয়া। আর এই সময়ে আওয়ামী লীগ তার নিজের দলেরও সংস্কার করে পুনর্গঠন করতে পারে। দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের কবল থেকে দলকে মুক্ত করে প্রকৃত ত্যাগী নেতাকর্মীদের হাতে দল পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের সুবিচার নিশ্চিত করতে আদালতে আইনি সহায়তা প্রদান করতে পারে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজন পরিচালনার জন্য অর্থসহায়তা এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে আইনি ও অর্থ সহায়তার মাধ্যমে তাদের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগ উপর্যুক্ত দুটি কাজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে করলে তাদের দল রক্ষা পাবে এবং ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় যাওয়ার পথও তাদের তৈরি হবে।

আওয়ামী লীগের মতো অন্যসব রাজনৈতিক দলও বাংলাদেশের কল্যাণ চায়- এমনটি তারা দাবি করে। সত্যিকার অর্থে যদি তারা বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ চায় তাহলে তাদের এখনই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। আমার গত লেখায় বলেছি, আওয়ামী লীগকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া ওই ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে না। সুতরাং রাগ-অভিমান ভুলে সংস্কার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে সম্পৃক্ত করা দরকার এখনই।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ আর বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাকে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপলে ভুল হবে। কারণ ১৯৭১ সালে জামায়াতের প্রতি ২ থেকে বড় জোর ৪ ভাগ মানুষের সমর্থন ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এখনও ২৫ ভাগের অধিক জনসমর্থন আছে। ২ ভাগ মানুষকে বাদ দেওয়া আর ২৫ ভাগ মানুষকে বাদ দেওয়ার চিন্তা এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা রাজনৈতিক বোকামি হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে কি চায় তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তারা যে এক-এগারোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অথবা ছিয়ানব্বই সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথে হাঁটছে না তা বোঝা যাচ্ছে। তাদের যে রাজনৈতিক অভিলাষ নেই; সেটি প্রমাণিত হবে যদি না তারা ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অতি দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। নির্বাচিত সরকারের যে শক্তি থাকে তা বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের নেই। সুতরাং তাদের দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকা দেশকে আরও সংকটে ফেলবে।

সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ নয়। বরং সংস্কারসহ পুরো নির্বাচনি রোডম্যাপ এখনই ঘোষণা করা দরকার। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন করার মাধ্যমে তার সূচনা হতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ ধাপে জাতীয় নির্বাচন করতে পারলে ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উচিত আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসা। অপ্রয়োজনীয় গ্রেফতার বন্ধ করা। রাজনৈতিক হয়রানি করতে মামলার খেলা বন্ধ করা। দুর্নীতিবাজ ও খুনের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার কাম্য। কিন্তু সেই বিচার প্রক্রিয়া হতে হবে নিরপেক্ষ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত আন্দোলনকারীদের যেমন ন্যায়বিচার প্রাপ্য তেমনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের যে কর্মী নিহত হয়েছেন তারও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। বিচারের নামে সংস্কারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করলে তা বাংলাদেশের জন্য শুভকর হবে না।

শেখ হাসিনার একতরফা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমেছিল অনির্বাচিত সরকারের শাসনে শাসিত হবার জন্য নয়। এই বাস্তবতা যত দ্রুত ড. ইউনূসের সরকার বুঝতে পারবে ততই দেশের মঙ্গল হবে। দ্রুত সব সংকট কেটে যাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/রন