বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে হজযাত্রী পরিবহনের বিষয়টি কয়েক বছর ধরে আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘসময় এবং নানা চ্যালেঞ্জের কারণে আগের সরকার এতে খুব একটা আগ্রহী হয়নি। এ ছাড়া সৌদি সরকারেরও অনুমতি মেলেনি। তবে খরচ কম হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনে বেশ আগ্রহী। সম্প্রতি সৌদি আরব সফরের সময় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ বিষয়ে প্রস্তাব দিলে প্রাথমিক অনুমতি মেলে দেশটির। সমুদ্রপথে জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন করা গেলে বিমান ভাড়া থেকে খরচ ৪০ শতাংশ অর্থাৎ এক থেকে দেড় লাখ টাকা কমবে। যেতে-আসতে আট দিন করে ১৬ দিন এবং হজ পালনসহ মোট এক মাসের মতো সময় লাগবে বলে জানিয়ে জাহাজে করে হজযাত্রী পরিবহনে সৌদি আরব সরকারের চূড়ান্ত অনুমতির অপেক্ষায় ধর্ম মন্ত্রণালয়। হজযাত্রী পাঠাতে জাহাজ কিনতে ঋণসহায়তা চেয়েছে জাহাজ কোম্পানি। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে সৌদি আরব যাত্রায় নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই এ স্বল্প সময়ের মধ্যে জাহাজ কিনে আগামী বছরের হজে হজযাত্রী পাঠানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে।
আগামী বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করতে পারবেন। আগামী জানুয়ারিতে হবে হজ চুক্তি। এর আগে আগামী ৩০ নভেম্বর শেষ হবে নিবন্ধন। তাই খুব বেশি সময় হাতে নেই। জাহাজে হজযাত্রী পাঠাতে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। সৌদি আরব সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বাংলাদেশ যদি জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে, তখন আগামী জানুয়ারিতে হজ চুক্তিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ বিগত বছরগুলোতে সৌদি সরকারের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী অর্ধেক হজযাত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বাকি অর্ধেক সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স পরিবহন করেছিল।
স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশ থেকে জাহাজে হজ করতে যেতেন হজযাত্রীরা। পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে উঠতেন। এরও আগে হজযাত্রীরা জাহাজে উঠতেন মুম্বাই থেকে। সময় লাগতো কয়েক মাস। ১৯৮৪ সালে জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে হজের খরচ অনেক বেড়েছে। চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে সাধারণ প্যাকেজে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। বিশেষ হজ প্যাকেজের মাধ্যমে হজ পালনে খরচ হয় ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে সাধারণ প্যাকেজে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ হয় ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা। বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে হজ পালনে খরচ হয়েছিল ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩০০ টাকা। খরচ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর কোটার চেয়ে ৪১ হাজার ৯৪১ জন কম হজ পালন করেছেন। তবে এবার হজের খরচ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জাহাজের হজযাত্রীদের সেবায় স্থাপনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ হজযাত্রী বৃদ্ধ। তারা এই দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল নিতে পারবেন কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। জাহাজে থাকার সময় হজযাত্রীরা অসুস্থ হলে কীভাবে তাদের চিকিৎসা হবে, তারা কীভাবে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন-এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। আগামী বছর হজের প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সৌদি আরব সফর করে। গত ৬ অক্টোবর সৌদির হজ ও ওমরাহবিষয়কমন্ত্রী তাওফিক ফাউযান আল রাবিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ধর্ম উপদেষ্টা। সেখানে সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে প্রস্তাব দেন তিনি। সৌদির হজ ও ওমরাহবিষয়কমন্ত্রী জানান, সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পাঠানোর ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের কোনো আপত্তি নেই। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকেও জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজে দু-তিন হাজার হজযাত্রী পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার চিন্তাভাবনা করছে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। এরপর গত ৯ অক্টোবর জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনে জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সেই বৈঠকে হজযাত্রী পরিবহনে জাহাজ কেনার জন্য সরকারের কাছে ঋণসহায়তা চায় জাহাজ কোম্পানি। এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় তাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার বলেন, জলপথে জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর চেষ্টা আমরা করছি। সৌদি আরবের বন্দরের অনুমতি লাগবে। জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর জন্য সৌদি আরব মুখে বলেছে, এখন তাদের চূড়ান্ত অনুমতিটা আমরা নেবো। চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার পর হয়তো জাহাজ মালিকদের নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেবো জাহাজে হজযাত্রী পাঠাতে পারবো কি পারবো না। জাহাজ মালিকদের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অণুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম বলেন, জাহাজ কোম্পানি এবার জাহাজ দিতে পারলে আমরা হজযাত্রী পাঠানোর চেষ্টা করবো। তারা প্রস্তুত থাকলে জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে সৌদির সঙ্গে চুক্তিও করবো। জাহাজে গেলে খরচ কিছুটা কমবে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমতির জন্য আমরা সৌদি আরবকে লিখেছি। জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে যে আলাপ হয়েছে সে অনুযায়ী জাহাজ কিনে তারপর হজযাত্রী পাঠাতে হবে। এ জন্য তারা সরকারের কাছে ঋণ চেয়েছেন।
কয়েক বছর ধরেই জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে আগ্রহের কথা জানিয়ে আসছে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স। এ জন্য তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছিল। এ বিষয়ে তাদের একটি জরিপ রয়েছে বলেও জানা গেছে। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ রশিদ বলেন, জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমরা এবার হজযাত্রী পাঠানোর চেষ্টা করছি। সৌদি আরব মুখে অনুমতি দিয়েছে, এখন চূড়ান্ত অনুমোদের জন্য তাদের কাছে চিঠি লেখা হচ্ছে। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি আসার পর আমরা এ বছর হজযাত্রী পাঠানোর চেষ্টা করবো। এ বছর জাহাজে হজযাত্রী পাঠাতে পারবেন কিনা- জানতে চাইলে এম এ রশিদ বলেন, সরকার যদি সিরিয়াস হয়, আমাদের যদি সহযোগিতা করে, তবে সম্ভব। এটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, অমুক-সমুক কত কিছু জড়িত। এটা সরকারের ওপর নির্ভর করে যে তারা কত তাড়াতাড়ি চূড়ান্ত করতে পারে, সেটা দেখার বিষয়। যাত্রী হবে কি না এ বিষয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের এমডি বলেন, যাত্রীরা তো জাহাজে চড়ে হজে যাওয়ার জন্য পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। যাত্রীর কোনো অভাব নেই। জাহাজে হজে গেলে খরচ অনেকটাই কমে আসবে জানিয়ে এম এ রশিদ বলেন, জাহাজে হজযাত্রী পাঠালে (বিমান থেকে ভাড়া) খরচ ৪০ শতাংশ কমে যাবে। এখন যেখানে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়, সেখানে আমরা ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকার একটা প্যাকেজের হিসাব দিয়েছি। জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে প্যাকেজের টাকা এক থেকে দেড় লাখের মতো কমবে। তবে প্যাকেজ সরকার বা এজেন্সি করবে। আমরা শুধু ক্যারিয়ার হবো বিমানের মতো। যেতে ও আসতে আট দিন করে সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠাতে হলে জাহাজ কিনতে হবে জানিয়ে এম এ রশিদ বলেন, সৌদি আরবের চূড়ান্ত অনুমতির পর আমরা জাহাজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করবো। জাহাজ আনা তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। জাহাজ ভাড়া আনলে প্রতিদিনের ভাড়া ৫০ হাজার ডলার। ভাড়া এনে হজযাত্রী পরিবহন করলে পোষাবে না। ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। জাহাজ কিনতে অনেক টাকা লাগবে জানিয়ে এ জাহাজ মালিক বলেন, জাহাজ নির্মাণকারীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ফান্ড আছে। গত চার বছর তো সেখান থেকে কোনো টাকা ছাড় হচ্ছে না। সেখান থেকে জাহাজ কেনার জন্য আমরা এক হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছি। প্রস্তুতির বিষয়ে এম এ রশিদ বলেন, চট্টগ্রামে আমাদের জেটি রয়েছে। ইমিগ্রেশনটা সৌদি আরবে হলে এক রকম, আর আমাদের এখানে হলে আমরা চেষ্টা করবো চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে করার জন্য। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আমাদের জেটির দূরত্ব পাঁচ মিনিট। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন হওয়ার পর এসে জাহাজে উঠে পড়বে। সরকার চাইলে সবই সম্ভব। প্রাথমিকভাবে আমরা তিন-চার হাজার হজযাত্রী পাঠানোর চিন্তা করছি।
জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি ফারুক আহমদ সরদার বলেন, এবার হজের আগে এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে জাহাজে হজযাত্রী পাঠানোর সুযোগ নেই। ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই ভালো হবে বলে আমরা মনে করি। এটি হলে হজযাত্রীরা আরও অনেক কম খরচে হজে যেতে পারবেন। এতে অনেকেই হজ পালনে আগ্রহী হবেন। জাহাজে যেতে যে আট দিন লাগবে, এই সময়ের মধ্যে হজযাত্রীদের খুব ভালোভাবে ট্রেনিংয়ের কাজটি করা যাবে। জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনে নানা ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে জানিয়ে হাব সভাপতি বলেন, চট্টগ্রাম গিয়ে এই হজযাত্রীরা কোথায় থাকবেন? একটা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে পাঠাতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। সৌদি সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেও আগামী বছরের হজে জাহাজে হজযাত্রী পাঠানো সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি না।
ভোরের আকাশ/রন