ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার কমতি নেই; কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই কাজে আসছে না। বেঁধে দেয়া দামে গতকাল বুধবার কোথাও ডিম বিক্রি হয়নি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের দামেই অর্থাৎ ১৮০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে বাদামি ডিম। গতকাল নতুন দাম প্রতিজজন ১৪২ টাকা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এদিকে মধ্যস্বত্বভোগী ঠেকাতে উৎপাদকরা সরাসরি আড়তে ডিম বিক্রি করবেন বলে জানা গেছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে ডিম উৎপাদক এবং সরবরাহকারীদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। বৈঠক শেষে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান জানান, সব পর্যায়ে ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বুধবার (গতকাল) থেকেই নতুন দাম কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
মহাপরিচালক বলেন, বুধবার থেকে উৎপাদক পর্যায়ে ১০ টাকা ৯১ পয়সা, পাইকারিতে ১১ টাকা ১ পয়সা এবং খুচরায় ১১ টাকা ৮৭ পয়সায় প্রতিটি ডিম বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে হিসেবে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ডজন কিনতে খরচ হবে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। কিন্তু গতকাল বুধবার সরেজমিন ঘুরে নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করতে দেখা যায়নি। বন্ধ ছিল অধিকাংশ আড়ত।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ৭ থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে ১২টি নিত্যপণ্যের দাম নতুন করে বেড়েছে। ডিমের দাম নতুন করে বেড়েছে ডজনপ্রতি ১২ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাম উঠেছে ডজনপ্রতি ১৮০-২০০ টাকায়। দর কমাতে বাজারে অভিযানের পর ডিম বিক্রিই বন্ধ রেখেছে পাইকাররা। অনেক বাজার বিশেষ করে অলিগলির মুদি দোকানগুলোতে ডিমই পাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল মগবাজার দিলুরোডের দোকানগুলোতে এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকায়। সায়েম মুদি দোকানের কর্মচারী মো. কাশেম ভোরের আকাশকে বলেন, ডিমের সরবরাহ নেই। আড়তের দামের সঙ্গে তাল মেলানো যাচ্ছে না। তার মধ্যে অনেক ডিম নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়। লোকসানে ডিম বিক্রিতে মালিক রাজি হচ্ছেন না বলে জানান মো. কাশেম।
মগবাজার পেয়ারাবাগ বাজারের কয়েকটি ডিমের বড় দোকান রয়েছে। গতকাল সেই দোকানগুলোতে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক সংখ্যক ডিম পাওয়া যায়নি। দোকানদার সেলিম উদ্দিন জানান, স্বাভাবিক সময়ে দোকানে কয়েক হাজার ডিম থাকে। আড়ত গিয়ে দাম শুনে হতাশ। তাই বেশি দাম আনতে পারেনি বলে জানান সেলিম উদ্দিন। এভাবে সারাদেশেই এমন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক মূল্যের দ্বারে ভিড়তে পারছেন না খুচরা বিক্রেতারা।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের অধিকাংশ আড়ত বন্ধ ছিল। কারওয়ান বাজারে কোথাও ডিম বিক্রি হতে দেখা যায়নি। জানা গেছে, গত রবি ও সোমবার রাতে ডিমের ট্রাক আসেনি। ফলে তৈরি হয় ডিমের সরবরাহ সংকট। একই দৃশ্য রাজধানীর কৃষি মার্কেটেও। ডিমের আড়তদাররা বলেন, ডিম রাখলে ১৮০ টাকা ডজন বিক্রি করতে হয়। এ দামে বিক্রি করতে গেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জরিমানা করে।
পাইকারি বাজারে ১৮০ টাকা দরে পাওয়া গেলেও পাড়ামহল্লার মুদিদোকানে ডিমের দাম ডজন ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় উঠে যায়। কোথাও ২২০ টাকা ডজন ডিম বিক্রির খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ডিমের দাম ও সরবরাহ নিয়ে আয়োজিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়- এখন থেকে ডিম উৎপাদক বড় কোম্পানি ও ছোট খামারিরা সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি ঢাকার আড়তে ডিম পাঠাবেন, মাঝখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। এর ফলে পাইকারি বিক্রেতারাও সরকার নির্ধারিত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ডিম বিক্রি করবেন। সভায় কাজী ফার্ম, প্যারাগণ, সিপিসহ বড় করপোরেট ব্যবসায়ী, খামারি এবং তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত দাম অনুসারে, প্রতিটি ডিমের দাম উৎপাদন পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা (ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা) হওয়ার কথা। ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকের পর আড়তদারেরা জানান, তারা ডিম বিক্রি শুরু করবেন।
সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলীম আক্তার খান। তিনি জানান, নতুন সিদ্ধান্তের ফলে দু-তিন দফা হাতবদল কমবে। ফলে ক্রেতারা কম দামে ডিম কিনতে পারবেন। তিনি বলেন, নতুন এ পদ্ধতিতে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্রি চলবে। এ সময়ে আমরা পর্যালোচনা করে দেখব যে এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে চলমান রাখা যাবে কি না।
এদিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিফ্রিংয়ে গতকাল জানানো হয়, ডিম আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ককর ৩৩ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে সরকার সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। যদিও তা আসা শুরু হয়নি। বাজারের ঊধ্বগতি সামাল দিতে স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য সুলভে ১০ পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিপনন অধিদপ্তর। রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় খাদ্য ভবনের সামনে গত মঙ্গলবার কৃষি ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির উদ্বোধন করেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ন্যায্যমূল্যে ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও সবজি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানানো হয়। এ কর্মসূচির আওতায় একজন গ্রাহক ৩০ টাকায় এক কেজি আলু, ১৩০ টাকায় এক ডজন ডিম, ৭০ টাকায় এক কেজি পেঁয়াজ, ২০ টাকায় ১ কেজি কাঁচা পেঁপে ও পাঁচ কেজি বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাক-সবজি প্যাকেজ আকারে (একসঙ্গে) কিনতে পারবেন। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ২০টি জায়গায় ট্রাক সেলের (ট্রাকে করে বিক্রি) মাধ্যমে এসব কৃষিপণ্য বিক্রি করা হবে। জায়গাগুলো হচ্ছে সচিবালয় এলাকার খাদ্য ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুর-১০, বাসাবো, বছিলা, রায়ের বাজার, রাজারবাগ, মুগদা উত্তর, মুগদা দক্ষিণ, পলাশী মোড়, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বেগুনবাড়ি, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা ও জিগাতলা।
এদিকে পোশাকশ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে গতকাল। এটি শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ। এ কর্মসূচির আওতায় পোশাকশ্রমিকরাও ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল কিনতে পারবেন। গতকাল সকাল ১০টায় গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস কারখানার সামনে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। জানা গেছে, আজ সীমিত পরিসরে এ কর্মসূচি চালু করা হবে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের এক হাজার পরিবারের মধ্যে পণ্য বিতরণ করা হবে। এর আওতা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে। দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি ডাল ও পাঁচ কেজি চাল প্যাকেজ আকারে পাবেন শ্রমিকরা।
ভোরের আকাশ/রন