বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো প্রত্যাহার করার জন্য বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ধীরে ধীরে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। গত সোমবার বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম এক সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। মামলা প্রত্যাহার করা না হলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন সেটি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরাও বিষয়টি বুঝতে চাইছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মামলা চলমান থাকায় তিনি কি দেশে ফিরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? নাকি মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন? খবর বিবিসির।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকেই ভেবেছিলেন তারেক রহমান হয়তো দ্রুত দেশে ফিরে আসবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় আড়াই মাস পার হতে চললেও তারেক কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন সেটি নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরে আসবেন সেটি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না বিএনপি নেতারা। তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলছিলেন, বিএনপির তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কেউ হয়রানি থেকে বাদ যাননি। তারেক রহমান শুধু তার নিজের মামলা নিয়ে চিন্তা করছেন না। বিএনপির নেতাকর্মী, সমমনা রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনচেতা মানুষের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছরে অসংখ্য মামলা করা হয়েছে। তিনি চান প্রতিটি মিথ্যা মামলা যেন প্রত্যাহার করা হয়।
বিএনপি বরাবরই দাবি করছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ ৪৫ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে বিএনপির এই দাবি কতটুকু সত্য যেটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। মাহদী আমিন বলেন, তারেক রহমান যাতে দেশে ফিরে আসতে পারেন সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আইনগত এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এমনও হতে পারে যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হয়ে গেল, কিন্তু অন্য নেতাকর্মীদের নামে মামলা রয়ে গেল। তিনি চাচ্ছেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত সবার মানবাধিকার যাতে সুরক্ষিত থাকে এবং তারা যেন আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত না হয়। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলে তিনি দেশে ফিরবেন।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ইতোমধ্যে তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহার করার জন্য দাবি তুলে ধরেছেন। তাদের অনেকের আশঙ্কা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি এবং নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। এমন অবস্থায় মামলা প্রত্যাহার করার আগে তিনি দেশে আসলে বিষয়টি ইতিবাচক নাও হতে পারে। এজন্য তারেক রহমান দেশে ফিরে আসার আগে মামলাগুলো প্রত্যাহার করানো সম্ভব হলে সেটি তার জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হবে। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও তারেক রহমানের অন্যতম আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, প্রায় আড়াই মাস হতে চললো কিন্তু এখনো পর্যন্ত মামলা প্রত্যাহার করার কোন সাইন (লক্ষণ) দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটা মামলা ভিত্তিহীন। গায়েবি মামলা করা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর সারাদেশের মানুষের এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল এসব মামলা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে।
ঠিক এর এক সপ্তাহ আগে কায়সার কামাল বলেছিলেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মামলা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবেলা করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কায়সার কামাল তখন বলেন, আমরা সব সময়ই বলে আসছি, আইন-আদালত-সংবিধানের প্রতি তারেক রহমান সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল। তিনি জানেন তার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, প্রতিটি মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা ও বানোয়াট। ভিত্তিহীনভাবে কয়েকটি মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। তার পরও তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো মোকাবিলা করা হবে।
তারা কি সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেনÑ এমন প্রশ্নে কায়সার কামাল বলেন, না, কোনো অবস্থাতে সরে আসিনি। মামলা প্রত্যাহার করার বিষয়টি আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ। শুধু তারেক রহমানের মামলা নয়, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে’ আওয়ামী লীগের সময় যেসব রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল সে সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মামলা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখনো বিগত সরকারের নিয়োগ করা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) রয়েছে। তাদের পদ থেকে না সরালে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
কায়সার কামাল জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া ১৭টি মামলার মধ্যে অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা এবং সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় সাজা হয়েছে। এছাড়া কর ফাঁকি, চাঁদাবাজির বাকি ১৫টি মামলা স্থগিত রয়েছে। মোট পাঁচটি মামলায় তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০টির বেশি মানহানির মামলা আছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ও ব্যবসায়ীদের আটক করা হয়। তারেক রহমানকে ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়ে লন্ডন চলে যান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দুটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর মধ্যে একটি জেলা পর্যায়ের কমিটি এবং অন্যটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি। এ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক 'হয়রানিমূলক মামলা' প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হবে। জেলা কমিটি সুপারিশ দেয়ার পর সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এবং প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করা হবে। এরপর তালিকা তৈরি করে মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি। জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, মামলা প্রত্যাহারের আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যায়িত কপি দাখিল করতে হবে। আবেদন পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটান পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন। এরপর ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) তার মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন। জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশ পাবার পর মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করবে এবং মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
ভোরের আকাশ/রন