logo
আপডেট : ১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৫৮
এইচএসসির ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ এবং উত্তরণের উপায়
অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান

এইচএসসির ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ এবং উত্তরণের উপায়

২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল গত মঙ্গলবার বেলা ১১টায় সারাদেশে একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত ফলাফলে সারাদেশে গড় পাসের হার ৭৭.৭৮, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৭০. ৩২। যা সর্বশেষ গত ৫ বছর পাসের হারের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই সময়ে ক্রমান্বয়ে প্রতিবছর (২০২০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত) এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কমলেও গত বছরের তুলনায় এবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তবে তার আগের তিন বছর (২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল। এ ছাড়া এই শিক্ষা বোর্ডে এবারও ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে আছে।

মঙ্গলবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪ সালের প্রকাশিত ফল পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা যায়। শিক্ষা বোর্ডের অডিটরিয়ামে এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। ফল প্রকাশ অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম। ফলাফল ঘোষণা করেন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এ এম এম মুজিবুর রহমান। প্রকাশিত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ। যা গতবার (২০২৩) ছিল ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর আগে যথাক্রমে ২০২২ সালে ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ; ২০২১ সালে ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১০০ শতাংশ (করোনার কারণে পরীক্ষা না হওয়ায় অটোপাস)। এছাড়া এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০ হাজার ২৬৯ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৭৫৯ জন এবং ছাত্র ৪৫১০ জন। আর ২০২৩ সালে জিপিএ ৫ পেয়েছিল ছয় হাজার ৩৩৯ জন। এর আগের তিন বছর জিপিএ ৫ বেশি ছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালে ১২ হাজার ৬৭০ জন, ২০২১ সালে ১৩ হাজার ৭২০ জন এবং ২০২০ সালে ১২ হাজার ১৪৩ জন ছাত্রছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছিল। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ২৮২টি কলেজের মোট পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ছয় হাজার ২৯৮ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ পাঁচ হাজার ৪১৬ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৭৪ হাজার ১২৫ জন। যা গতবারের তুলনায় এবার পাসের হার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। তিনটি শাখার মধ্যে পাসের হার বিজ্ঞানে ৯১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং মানবিক বিভাগে ৫৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এবার ছাত্র পাসের হার ৬৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ছাত্রী পাসের হার ৭২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ছাত্রদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে চার হাজার ৫১০ জন। ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫৯ জন। এই হিসাবে এবারও ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা- দুই দিক থেকেই এগিয়ে।

ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ-মূলত: পরিবারের দায়িত্বহীনতা এবং অর্থনৈতিক দ্বৈনতায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী না হওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির চর্চা। মূলত, আর্থিক সুবিধা নিয়ে ও দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ। বছর বছর কারিকুলাম পরিবর্তনের কারনে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সিলেবাস অনুসরণ করতে না পারা। অটো পাসের মানসিকতা। করোনা মহামারীসহ নানাণ কারণে বেসিক দুর্বলতা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব। ফলাফল বিপর্যয় থেকে উত্তরণের উপায়- অন্তত, এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি এখনই বন্ধ করতে হবে। শিক্ষককে মাঠের রাজনীতি থেকে শতভাগ দূরে থাকতে হবে। যারা স্কুল শাখা ছাত্র সংগঠনের কমিটি করলেন তারা এখন কোথায়? মাঝখানে ছেলেগুলোর তেরটা বেজে গেল। পরিবারকে শিক্ষা খাতের ব্যায়কে বিনিয়োগ মনে করতে হবে। অভিভাবককে কলেজে গিয়ে মেয়ে-ছেলের উপস্থিতি ও ফলাফল দেখে আসতে হবে। সন্তান পড়ছেন আর অভিভাবক বিশেষত: মা, ক্ষেত্রবিশেষে পিতা ফেসবুকিং করছেন- এ অবস্থা থেকে সরে আসতেই হবে।
রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনতে সময়োপযোগী বেতন নির্ধারণ, শিক্ষকের কাঙ্খিত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং ফ্রি শিক্ষকতা করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতাই হতে হবে একমাত্র মাপকাঠি। বছর বছর কারিকুলাম পরিবর্তন এখনই বন্ধ করতে হবে। সরকারকে শিক্ষা খাতের ব্যয়কে বিনিয়োগ মনে করতে হবে। শিক্ষককে কম্পিউটার জানা, চরিত্রবান, সময়নিষ্ঠ, পাঠদানে আন্তরিক, শব্দচয়ন ও বাচনভঙ্গিতে যত্নশীল, ক্লাসে ফোন ব্যবহারে বিরত থাকা, অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলাদা ব্যাচ করা, উচ্চবিলাসী জীবনযাপন করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ, প্রতিদিনের পাঠ প্রতিদিন সম্পন্নকরণ, গ্রুপস্টাডি, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমে আরো গতিশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীকে পড়ালেখা না করে পাস বা অটো পাসের মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

লেখক- সাবেক অধ্যক্ষ, তাহের-মনজুর কলেজ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, দৈনিক ভোরের আকাশ।

 

ভোরের আকাশ/রন