সাম্প্রতিক দুটি ঘোষণা আমাদের আশ্চর্য করেছে। প্রথমত, আটটি জাতীয় দিবস বাতিল এবং দ্বিতীয়ত, উপদেষ্টা নাহিদের বক্তব্য, ‘অন্তর্বর্তী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে বিবেচনা করে না।’
জাতীয় দিবস বাতিলের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের মতামত প্রায় একই। তবে, দ্বিমত রয়েছে তিনটি দিবস নিয়ে- ৭ মার্চ (বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি); ১৫ আগস্ট (বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যাকাণ্ডের দিন) এবং ৪ নভেম্বর (গণপরিষদে যেদিন সংবিধান গৃহীত হয়)। এই দিনগুলোতে ইতিহাস রচিত হয়েছিল এবং কোনোভাবেই এগুলোর গুরুত্ব কমানো উচিত নয়।
আমাদের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানীসহ আরও অনেকেরই অবদান রয়েছে এই সংগ্রামে। নিজ নিজ অবদান অনুযায়ী ইতিহাসের পাতায় তাদের অবিস্মরণীয় অবদান ইতোমধ্যেই স্বীকৃত।
আমাদের মতে, বঙ্গবন্ধুর অবদান দুটি পর্যায়ে বিচার করা উচিত। প্রথম. স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশের ফিরে আসার পর। প্রথম পর্যায়ে তরুণ বয়স থেকেই তিনি বাঙালির অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হওয়া, সেটা দাবি করা এবং প্রয়োজনে সেই দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করার আত্মবিশ্বাস তিনি আমাদের মধ্যে এনে দেন। সর্বমোট ১৩ বছর কারাবন্দি থাকলেও তিনি কখনোই আপস করেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুখপাত্রে পরিণত করে। স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব অসামান্য সাহস ও সততার সঙ্গে পালন করেছেন। পাকিস্তানি শাসকের শৃঙ্খল থেকে আমাদের মুক্ত করার যে সংগ্রাম তা তিনি আজীবন করে গেছেন, তাতে কোনো দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। তিনিই সেই নেতা, যিনি হিংস্র ও বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদেরকে অস্ত্র ধরার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তার সেই অবিস্মরণীয় বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সর্বস্তরের সাধারণ বাঙালিদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনিই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। কিন্তু তিনি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেন- বিশেষত, একটি গণতান্ত্রিক নীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। রক্ষীবাহিনী গঠন এবং রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এই বাহিনীর ব্যবহার সবসময়ই সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু মূলত যে কারণে তার ভাবমূর্তি ও সম্মানহানি হয়েছে সেটা হলো- ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে একদলীয় শাসন কায়েম করা। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা। এমন অনেক নেতাই আছেন, যারা বিপ্লবে সফল হলেও জাতি গঠনে কিছুক্ষেত্রে গুরুতর ভুল করেছেন। তারা এমন সব ভুল করেছেন; যা দেশের মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ, দুর্দশা, এমনকি তাদের মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে চীনের মহান নেতা মাও সেতুংয়ের কথা মনে পড়ে। তার পুরোটা জীবন কেটেছে দেশের মানুষকে ভালোবেসে, তাদের জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ ও ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’ নীতি বাস্তবায়নের ফলে অগণিত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নিপীড়ন হয়েছে। অন্যান্য বিশ্বনেতার এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুও অনেক ভুল করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ব্যক্তিদের মতো তাকেও সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হবে, যদি যোগ্য ইতিহাসবিদদেরকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়- রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের নয়। আমরা কোনোক্ষেত্রেই যেন শেখ হাসিনার আদ্যোপান্ত ত্রুটিপূর্ণ, অগণতান্ত্রিক, জনস্বার্থবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতালোভী, অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান মূল্যায়ন না করি। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ঐক্যবদ্ধ করা, আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলা, ছয় দফা দাবি তোলা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন, ৭ই মার্চের ভাষণ এবং ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে কার্যত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে অকার্যকর করে দেয়া আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় মুহূর্তগুলোর অন্যতম; যা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও অবিসংবাদিত ভূমিকার কারণে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনমানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা- বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা (অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ের মতো)- অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এর সবই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, উপস্থিতি ও দ্ব্যর্থহীন নেতৃত্বের কারণে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, সেটা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর এসব ভূমিকাকে আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখতে পারি না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেকেরই ইতিহাস সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রতি আমাদের সম্মান থাকবে। কিন্তু, অনেকে হয়তো ষাটের দশকের শেষের দিকের সেসব দিনগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, ১৯৭০ সালের জাদুকরী মুহূর্ত ও ১৯৭১ সালে আমাদের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অসামান্য গুরুত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন। আমরা যারা সেই সময়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি, তারা একই সঙ্গে সে সব দিনগুলো এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার জীবন্ত প্রমাণ। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিজেদেরকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতে আমরা ৭ই মার্চের ভাষণের রেকর্ডিং শুনতাম। আজকের তরুণ প্রজন্ম- যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। তারা হয়তো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলে শেখ হাসিনার অপশাসন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সাড়ে ১৫ বছরের ইতিহাসকেই সামনে পাবে। বিশেষত, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন সপ্তাহে সাধারণ মানুষ, পথচারী, রাস্তার হকার, বিক্ষোভরত শিক্ষার্থী ও জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করায় যতটুকু সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা শেখ হাসিনা ও তার দলের ছিল তাও পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে এবং তার বদলে স্থান পেয়েছে ঘৃণা- যার ফলাফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
গত দেড় দশকে, বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচন আওয়ামী লীগকে একটি ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত করে। দলটি পুরোপুরি দুর্নীতিতে ডুবে যায় এবং নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। শেখ হাসিনা অতিমাত্রায় অহংকারী হয়ে পড়েন; ক্ষমতার মোহে মগ্ন হন; সামান্যতম সমালোচনাও তিনি সহ্য করতে পারতেন না; স্বাধীন গণমাধ্যমের পথরোধ করেন এবং সংবিধান উপেক্ষা করতে থাকেন। ‘দেশকে আমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসে না’ বা ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার কোনো ভুল হতে পারে না’- এমন অবাস্তব গর্বে তিনি ডুবে থাকেন। ফলে, আওয়ামী লীগ লোভী, চাটুকার ও স্বার্থান্বেষীদের দলে পরিণত হয়; যারা দেশে লুটপাট চালিয়ে বিদেশে অর্থপাচার করতে থাকে।
আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিতে সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রক্রিয়া এবং এর জন্য জনগণের অর্থের মাত্রাতিরিক্ত অপচয়। এই আয়োজনে তাকে দেবতুল্য করে দেখানো হয়; যা গণতান্ত্রিক দেশে গ্রহণযোগ্য নয়। বাঙালিরাও স্বভাবগতভাবেই এমন ব্যক্তিপূজা ঘৃণা করে। রাষ্ট্রের আদেশে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাজারো বই ছাপানো হয়েছে এবং তার অসংখ্য ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস, ব্যাংক, হোটেল, বিমানবন্দরসহ অসংখ্য জায়গায় ‘মুজিব কর্নার’ স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রত্যেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চ-মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তার জন্য যেকোনো বক্তব্যের শুরুতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট বঙ্গবন্ধুর গুণগান এবং এরপর শেখ হাসিনার গুণগান করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এগুলো ছিল অরুচিকর সংস্কৃতি। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন আতঙ্কও তৈরি হয় যে, তাদের এই গুণগান যদি কোনো কারণে মনপূত না হয়, তাহলে তারা এমনকি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেও পড়তে পারেন। এভাবেই চলছিল সবকিছু। তার পরের বছরটি ছিল আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছর। সেখানেও সবকিছু একইভাবে চলতে থাকে। মনে হচ্ছিল, শেখ হাসিনার বাবা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আর কারো কোনো ভূমিকাই ছিল না। সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে প্রায় পুরোপুরি বাদ দেয়া। ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন শুরু হয়; যা বিগত সরকারের শেষদিন পর্যন্ত উদযাপিত হচ্ছিল এবং এক্ষেত্রে তারা ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে ‘জনগণের বাংলাদেশের’ বদলে ‘মুজিবের বাংলাদেশের’ ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
শেখ হাসিনা সরকারের এসব বাড়াবাড়ি সামগ্রিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে কলুষিত করেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা- যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর কোঠায়- নিজেদের জীবদ্দশায় শুধু একটি সরকারকেই দেখেছে। সেটা হলো গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করা শেখ হাসিনার সরকার। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণা গঠনে শেখ হাসিনা সরকারের শোষণমূলক আচরণ বড় ভূমিকা রেখেছে; যা কেবল তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও ঘৃণারই জন্ম দিয়েছে। স্বভাবতই, ‘উন্নয়নের গল্পগুলো’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও লাগামহীন দুর্নীতির নিচে চাপা পড়ে গেছে।
যদি গত সাড়ে ১৫ বছরে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে ভালো-খারাপ মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে বিচার করা হতো, তাহলে তার প্রকৃত অবদান নিয়ে কখনোই প্রশ্ন উঠত না। শেখ হাসিনা কখনোই বুঝতে পারেননি যে সত্য অবিনাশী আর প্রোপাগান্ডা শুধুই নিজের শাসনামল টিকে থাকা পর্যন্তই কার্যকর। আমরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করব, তারা যেন শেখ হাসিনার অপশাসনের পাল্লায় বঙ্গবন্ধুকে না মাপে। আমাদের দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনা তার বাবার অবদানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি চালু করে; যা আমাদের সবার মনে ঘৃণা তৈরি করেছে এবং তার অসাধারণ সাহস, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টি ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে মন থেকে মুছে দিয়েছে। শেখ হাসিনা তার বাবাকে একজন ‘নির্ভুল’ মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম বাধ্য হয়ে তার অবদান ও প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। শেখ হাসিনার এসব কর্মকাণ্ড রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানের কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলি করি অপমান’।
আমরা অসংখ্যবার দেখেছি, রাজনীতির পালা বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে আমাদের ইতিহাসের বর্ণনা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনরা নিজেদের মতো করে বদলে নিয়েছেন। নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ‘সত্য’কে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছে।
শুরুতে ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে শুধুই আওয়ামী লীগ। অন্য কোনো দল, গোষ্ঠী, এমনকি সাধারণ মানুষেরও স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা ছিল নগণ্য। অথচ, মুক্তিবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। তাদেরকে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, বলা হয়েছে তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সদস্য। খন্দকার মুশতাক, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে ইতিহাস বর্ণনায় শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ বন্ধ হয়ে যায়। তার বদলে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নাম বসিয়ে দেয়া হয়। তারপর একনায়কতন্ত্রের পতনের পর দৃশ্যপটে খালেদা জিয়ার আবির্ভাব হয় এবং সেই সঙ্গে আসে জেনারেল জিয়ার নাম। তখনকার বর্ণনায়, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুই হয় জেনারেল জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায়। বলা হলো, এর আগে কিছুই হয়নি। যার উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে যেন কোনোভাবেই দৃশ্যপটে আনার সুযোগ আর না থাকে। এই পুরো সময়টাজুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ওপর গণহত্যা চালানো বাহিনীকে ‘হানাদার বাহিনী’ নামক এক উদ্ভট নামে ডাকা শুরু হলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নাম লেখার বিষয়ে আরোপ হয়েছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ইতিহাসের এই বর্ণনা আবারও বদলে গেল। হঠাৎ করেই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেলেন জেনারেল জিয়া। মুক্তিযুর শুরু থেকেই তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে কোনো কথা বলা যেত না। পরিবর্তে তাকে ‘আইএসআই এজেন্ট’, ‘পাকিস্তানের গুপ্তচরের’ মতো কিছু মিথ্যা, লজ্জাজনক ও নিন্দনীয় তকমা দেয়া হয়।
ইতিহাস বিকৃতি ও প্রকৃত সত্যের রাজনীতিকরণের মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের শিশুরা বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে। যার জন্য শুধু শেখ হাসিনা একাই দায়ী নন। রাজনৈতিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক ইতিহাস প্রচার করার মাধ্যমে ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানানোর ধারা ধ্বংস হয়েছে, বিশেষত আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে। স্কুলের বইগুলো আমাদের অতীত ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ। দুই দলের বাইরের মানুষ ক্ষমতায় থাকায় এখনই সময় পরিবর্তন আনার। দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট বর্ণনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাদের বর্ণনা আমাদেরকে পক্ষপাত ইতিহাস ও অজ্ঞতার ফাঁদে আটকে রেখেছিল। শিক্ষার্থীরা আমাদের চিন্তা পরিবর্তনের সুবাতাস নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারা যেন এই পুরনো ফাঁদে পা না দেয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
১৯৭১ সালে আমরা একটি ভূখণ্ড অর্জন করেছি, কিন্তু জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারিনি। সমন্বয়ের বদলে নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছি। সবার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার বদলে আমরা বানিয়েছি শত্রু। একে অপরের অবস্থান বোঝার চেষ্টা না করে ইতিহাসের রাজনীতিকরণ করেছি; যা বিভাজনকে আরও বিস্তৃত করেছে। এখনই সময়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রকৃত চিত্রায়নে নজর দেয়ার। আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ক্ষতিকর সংস্কৃতি থেকে; যা এতকাল জাতিকে গড়ে তোলার শক্তিটুকু অন্যত্র ব্যয় করিয়েছে।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ভোরের আকাশ/রন