দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদিনই বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যত শিগগির সম্ভব নির্বাচন দাবি করছে। কেউ কেউ রোডম্যাপ দাবি করছেন অতিসত্বর। কেউ কেউ বলছেন, অন্তর্র্বতী সরকার নয় বরং রাজনৈতিক দলগুলোই ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় সংস্কার করবে। আবার যাদের ঘর খুব গোছানো নয়, তারা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে আরও কিছুটা সময় দিতে চান।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ছয়টা কমিশন গঠন করেছে। আশা করা যায়, তিন মাসের মধ্যে সংস্কারের রিপোর্ট শেষ করবে কমিশনগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো তাড়াতাড়ি নির্বাচন চাইবে, এতে দোষের কিছু নেই। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সতীর্থরা বিশেষ করে তরুণ সমাজ রাষ্ট্রীয় সংস্কার চাচ্ছেন। তাদের আন্তরিকতা নিয়েও কারও কোনো প্রশ্ন নেই, অন্তত এখন পর্যন্ত। ফল দাঁড়াবে, বিশেষজ্ঞরা কাগজে লিখে কিছু পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সুপারিশ করবেন, যেমন— বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সরকারের ধরন, সংসদের গড়ন ইত্যাদি। অন্তর্র্বতী সরকার এগুলোকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করবে এবং অন্তত আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার আসা পর্যন্ত এইসব সংশোধনী অনুসরণ করবে। আশা করা যায়, বিগত সরকারগুলোর শাসনব্যবস্থার দলীয়করণের বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে যেসব সংস্কারের কথা বলা হবে, সেগুলো উঁচুমানের হবে।
কিছু জিনিস আমাদেরকে এখন থেকেই বুঝতে হবে। শাসনব্যবস্থার পদ্ধতিগত যেসব সংস্কারের কথা বলা হবে, এগুলো শুধু অ্যাডপ্ট বা গ্রহণ করে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে না। এগুলোর উপযুক্ত চর্চা এবং নিয়মিত উৎকর্ষের মধ্যেই এগুলোর সফলতা নির্ভর করবে। বার বার পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। অন্তন্ত আগামী পাঁচটা নির্বাচন আমাদেরকে কোনোরকম অপব্যবহার ছাড়া একই প্রক্রিয়ায় করতে হবে। পদ্ধতির উন্নতি করা যাবে কিন্তু পদ্ধতি ভাঙা যাবে না; দলীয়করণ বা অপব্যবহার করা যাবে না।
ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মালয়েশিয়া চর্চা ও উৎকর্ষের মাধ্যমে এমন একটা পরিপক্কতায় পৌঁছেছে যে, সহজে সেখানকার প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করা সম্ভব নয়। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দল কিছু কিছু পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, কিন্তু ভাঙতে পারেননি। গত লোকসভার নির্বাচনের আগে যেখানে ভবিষ্যৎবাণীতে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি ৮০% আসন পাবে, সেখানে তারা এমনকি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি। মোদীকে ছোট একটি দলের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনপদ্ধতির অপব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।সংস্কার পদ্ধতিগুলো স্থবির হলে চলবে না। এগুলোকে নিরন্তর চর্চা করতে হবে এবং ক্রমাগত আরও উন্নত করতে হবে। আবার উৎকর্ষ উদ্দেশ্যমূলক হলে চলবে না। যেমন ধরুন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারে বিধান রয়েছে, দুই মেয়াদের বেশি কেউ সরকার প্রধান থাকতে পারবেন না। কিন্তু সরকারপ্রধান করিম মিয়া ভাবলেন, আরও এক টার্ম বেশি থাকলে ক্ষতি কী? দেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং বেশ উন্নয়নও করা যাবে। তিনি তার প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে উৎকর্ষের নামে বিধানের পরিবর্তন করলেন। কার সাহস করিম মিয়ার সমালোচনা করবে? আমাদের দেশে পুরানো নিয়ম, করিম মিয়াদেরকে সমালোচনা করা যাবে না। কটূক্তি করার জন্য মামলা হবে, সুযোগ পেলে করিমের সমর্থকেরা মারধর করবে। এই স্বভাবগুলো তো কাগজে বিধান লিখে পরিবর্তন করা যাবে না। একমাত্র দলীয় সংস্কারের মাধ্যমে এসবের ক্রমাগত পরিবর্তন করা যাবে। অন্যদিকে, বিচার বিভাগকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে করিম মিয়ারা প্রক্রিয়াগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে না পারেন।
আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদরা এইসব সংস্কার প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন এবং ক্রমাগত এগুলোকে আরও উন্নত করবেন। যখন আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভালো করার জন্য চেষ্টা চলছে ওই সময়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের সদস্যরা কি নিজেদের সংস্কারের কথা কিছু ভাবছেন? শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার করে কি কোনো লাভ হবে?
রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। দলগুলোর নেতা ও সমর্থকদের এতদিনের রাজনৈতিক চর্চার গুণগত মান যে রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে এই মান কখনোই উন্নত করা যাবে না। কোনো কোনো দলের জন্য এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আবার কোনো কোনো সংস্কার সব দলগুলোর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু সংস্কার না করলে পরিবর্তন কখনো আসবে না। এমন কিছু রাজনৈতিক সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধান এখানে তুলে ধরা হলো।
জাতি হিসেবে আমরা বড্ড বেশি রাজনীতি-আচ্ছন্ন: এর ফলাফল আমরা ভালোভাবেই জানি। সমাজে রাজনৈতিক কারণে হানাহানি বাড়ছে এবং মানুষের সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। এই অধিক রাজনীতিকরণের প্রধান কারণ কর্মবিমুখতা এবং কর্মসংস্থানের অভাব। জনগণ রাজনীতি নিয়ে বাকবিতণ্ডা করতে অঢেল সময় পেয়ে থাকে। বিরাজনীতিকরণের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান জরুরি। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা নিয়ে আমাদেরকে একটা জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে। একটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার রুটিনমাফিক চর্চা হলে, রাজনৈতিক বিতর্ক ও মেরুকরণ কমে যাবে। রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর মাঝে কিছুটা ভালো সম্পর্ক থাকলে কর্মীরাও তা অনুসরণ করবেন।
যুব, স্বেচ্ছাসেবক ও কৃষক অঙ্গসংগঠনসমূহের কি কোনো প্রয়োজন আছে? যে বয়সে তরুণেরা কর্মজীবনে সফলতা পেতে কাজ করে, ওই বয়সের বিপুলসংখ্যক তরুণকে সার্বক্ষণিক দলীয় কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলি আমরা। তরুণ কর্মীদেরকে যুব সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা, কৃষক সংস্থা এসব উপদলীয় ব্যবস্থায় এবং অনেকক্ষেত্রে তাদের উপার্জন উৎসকে দলবদ্ধ অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ নির্ভর করে ফেলি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত দিনগুলোতে এই তরুণেরা রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে। বেছে নিয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দোকান দখল, হাট-ঘাট দখল ইত্যাদি কাজকে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাগুলোকে কোনো স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে দেখা যায়নি কোনোদিন। ঢাকায় অনেক কৃষক সম্মেলন হয়, যেখানে স্যুট-কোট বা ধবধবে কাপড় পরে অকৃষক লোকজন কৃষক সাজেন।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি এসব যুব, স্বেচ্ছাসেবক, কৃষক অঙ্গসংগঠনসমূহ পরিহার করে, তাহলে তরুণদের অনিয়মতান্ত্রিক কাজকর্ম অনেক কমে যাবে, তাদের কর্মক্ষমতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়বে। এই তরুণদেরকে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কর্মসংস্থান করতে হবে। তরুণ সমাজ অবশ্যই রাজনীতি সচেতন থাকবে এবং নিজের দায়িত্বে রাজনীতি করবে, কিন্তু কোনোভাবেই রাজনীতিকে উপার্জনের উৎস হিসেবে বেছে নেবে না। যেসব তরুণ নিজ দায়িত্বে রাজনীতি করতে চায়, তাদের জন্য দলীয় দরজা খোলা থাকবে— মূল দলের পক্ষে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হবে।
শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতি: নতুন পরিস্থিতিতে ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি করবে কিনা, তা নিয়ে তাদের মধ্যে এখনো কোনো ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। এই বিষয়টা ছাত্রদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হোক। রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাত্র রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা পরিহার করতে হবে। বিগত আন্দোলনে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়েছে, ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করেও দেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবতেও কাজ করতে পারে।
অতীত ভুলের কথা সবাই ভুলে যায়: অতীতের ভুল স্বীকারের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের আস্থা খুঁজতে হবে। পূর্বের ভুলগুলোকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্রমান্বয়ে কাজ করতে হবে। ক্রমাগত ভুলের রাজনীতি নিয়ে জনগণ এতদিন নির্বিকার ছিল। তাদেরকে বলতে শুনেছি, সব দলই এক। করিম মিয়া যা করছেন, সগীর মিয়া আসলেও তাই করবেন। নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের সচেতনতা ও আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে সগীর মিয়ার দল দেখাতে পারবেন তারা করিম মিয়ার দলের চেয়েও ভালো। করিম মিয়াও নিজের অতীত ভুল স্বীকার করে জনগণের আস্থা ফিরে পেতে চেষ্টা করতে পারেন।
এদেশের জনগণ স্বাধীনতার পর থেকেই একক ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনব্যবস্থাতে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। গত পনেরো বছরে যা রূপ নেয় ফ্যাসিবাদে। নতুন প্রজন্ম আমাদেরকে বলছে, সামনে করিম মিয়া ও সগীর মিয়ার দল একই রকম হবে না। যারা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন করতে পারবেন তারাই দেশ শাসন করবেন। এই প্রজন্মের তরুণেরা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একটা নতুন উচ্চতায় নেওয়ার জন্য কাজ করছে। রাজনীতিবিদরাও নিজেদের ও দলীয় সংস্কারের মাধ্যমে একে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। এই গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং রাজনীতির সংস্কার সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের আপামর জনগণও এই পরিবর্তনের বড় অংশীদার। তাদেরকেও যে যার অবস্থান ও কর্ম-ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অবদান রাখতে হবে। এই ঐক্য হবে চলমান এবং জাতীয়ভাবে পরিপূর্ণ পরিপক্কতা অর্জনের অংশ।
লেখক: ডাকসুর সাবেক জিএস
ভোরের আকাশ/রন