logo
আপডেট : ২০ অক্টোবর, ২০২৪ ০৯:১৮
আ. লীগ ঠেকাতে বৃহৎ ঐক্য!
এম. সাইফুল ইসলাম

আ. লীগ ঠেকাতে বৃহৎ ঐক্য!

দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের ফিরে আসা ঠেকানোর প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াত, বাম ঘরানা ও ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে ফের ঐক্য জোরালো হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ যেন কোনোভাবেই পুনর্বাসিত হতে না পারে সে ব্যাপারে এসব দলগুলোর মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতেও তৎপর দলগুলো।

এ বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও গণসংহিত আন্দোলনের নেতারা দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেনÑ আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতির কাছে পরিচিত করেছে। দলটি সরাসরি গণহত্যায় জড়িত দাবি করে এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে সবাই এককাতারে থাকবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ, আওয়ামী লীগ দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। গুম, খুনের রাজনীতি করেছে। এছাড়া ‘জুলাই বিপ্লব’ ঠেকাতে দলটি যে নৃশংস হত্যকাণ্ড চালিয়েছে সে জন্য দলটিকে রাজনীতির রাইরে রাখার দাবি তাদের।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শুরু হয়েছে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালানোর পর বেকায়দায় আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাকর্মীর এখন বেশিরভাগই এলাকা ছাড়া। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের জুলাই গণহত্যার বিচারে জিরো টলারেন্স মনোভাবে দৃঢ় অবস্থানে। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা এখন কারাগারে। বাকিরা পালিয়ে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের যখন এই অবস্থা তখন দীর্ঘদিন সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করা বিএনপি, জামায়াত, বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল, ইসলামী রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলছে আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যের কাজ। এসব দল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও ঐক্য গড়তে কাজ করেছে। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলন করেছেন দলগুলোর নেতাকর্মীরা। তবে, তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার হিসাব একেবারে ভিন্ন। আগে তাদের ঐক্য ছিল আওয়ামী লীগকে হঠাতে। আর এখন তারা কাজ করছেন আওয়ামী লীগ যেন কোনোভাবেই পুনর্গঠিত হয়ে নতুন করে রাজনীতিতে আসতে না পারে সে বিষয়ে।

সরকার পতনের পর বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। দলটির চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওই বৈঠক হয়েছে। সেখানে দলটির মূল আলোচনা ছিল ঐক্য ধরে রাখা। এছাড়া আওয়ামী লীগ যেন কোনোভাবেই রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ না পায়। জামায়াতে ইসলামীও দফায় দফায় তাদের কার্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেছে। বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজনীতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও বসেছে দলটি। সেখানেও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিপ্লব পরবর্তী জাতীয় ঐক্য। সে ঐক্যের মাধ্যমে জাতিকে সঠিক পথ দেখানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে বিরুদ্ধে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসাই দলটির মূল টার্গেট। এছাড়া মতভেদ ভুলে ইসলামী দলগুলোকে একই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার দৃশ্য সম্প্রতি দেখা গেছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে। পাশাপাশি ইসলামী দলগুলোর কর্মসূচি বা সভা-সেমিনারে ডান-বাম সব ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। তাদের সভার বক্তব্যে আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যেরও আভাস মেলে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছরে দেশটাকে যেখানে নিয়ে গেছে তা কল্পনাও করাটা কঠিন। প্রতিটি সেক্টর দলটি শেষ করে দিয়েছে। আর বিরোধী দল দমনে তারা রেকর্ড করেছে। ভিন্নমত দমনে ঘৃণ্য সব কৌশল করেছে দলটি। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেখানে গণহত্যা চালিয়েছে তাতে দলটিকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের এদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম ভোরের আকাশকে বলেন, জামায়াত সরকার পতনের আগেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য চেয়েছে। এখনো বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য চাই আমরা। কারণ, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামায়াত। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন স্বৈরাচার না হয় সে জন্য আওয়ামী লীগকে শিক্ষা দেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, দেশের স্বার্থেই সবাই এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে চাইছে। কারণ, দলটি দেশে যে ক্ষতি করেছে তা কোনোভাবে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই তারা যেন কোনোভাবে রাজনীতিতে ফিরতে না পারে সে জন্য দেশের মানুষ এখন সবাই এককাতারে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে জাতির কাছে ফ্যাসিস্ট হিসেবে পরিচিত করেছে। এই দলটা যে সংখ্যক মানুষ খুন করেছে তাতে আওয়ামী লীগকে খুনি দল বলতেও দ্বিধা নেই। তিনি বলেন, অন্যায় অনিয়ম আর মানুষ হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ যেন রাজনীতিতে না ফিরতে পারে সেটিই এখন বেশিরভাগ মানুষের চাওয়া।

১/১১ পরিস্থিতির পর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের শুরুতেই সরকার গঠন করে দলটি। এর পরপরই বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখাতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। এছাড়া দলটি স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও তুলে দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর প্রতিবাদে মাঠে নামে বিএনপি ও জামায়াত। এছাড়া যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিশেষ করে জামায়াত নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করে আওয়ামী লীগ। জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় আওয়ামী লীগের সময়ে। এছাড়া ২০১৩ সালে আগস্টে সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেন। এরপর জামায়াত নিজস্ব প্রতীক ‘দাড়িপাল্লা’ মার্কা নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারায়। এরপর সবমিলিয়ে কঠোর আন্দোলনমুখী হয় দেশ। ২০১৪ সালের অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তা ঠেকাতে মাঠে নামে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটটি। সে সময় ব্যাপক ধরপাকড় আর নির্যাতন করা হয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের। একতরফা নির্বাচন করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ জোট। তারপরও টানা আন্দোলন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। ওই সময় থেকেই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু করে। গুম ও খুন হতে শুরু করেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। নানা রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটা সময় আন্দোলনও থেকে থেমে যায়।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাবন্দি করা হয়। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের নামেও দেয়া হয় অসংখ্য মামলা। পরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে ‘ঈমাম’ মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ভোটে যায়। ওই পাতানো নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলটি ফের একলা চলো নীতিতে চলতে থাকে। জামায়াতও অনেকটাই একলা চলো নীতিতে চলে যায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে দেড় বছর আগে থেকে বিএনপি-জামায়াত ও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অধীনে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। এরপর এসব দলগুলো ভোট বর্জন করলেও একতরফা ভোট করে ফের ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। বারবার পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে বেপরোয়া হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ সরকার। সবশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয়েছে স্বৈরাচারের তকমা লাগানো আওয়ামী লীগের। এমন বাস্তবতায় দলটির বিরুদ্ধে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ।

 

ভোরের আকাশ/রন