logo
আপডেট : ২০ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:১৩
‘সাজানো’ নিলামে জাহাজ বিক্রি
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

‘সাজানো’ নিলামে জাহাজ বিক্রি

পাঁচ কোটি টাকার জাহাজ ৫০ লাখে বিক্রি! বলা চলে, জলের জিনিস জলের দামেই বিক্রি করেছিল ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি। অভিযোগ আছে, বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এম এ লতিফের প্রভাবে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ‘ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেল’ নামের জাহাজটি নিলামে কিনে নেন তারই ভাতিজা আবদুর নূর জাবেদ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আটক হন সাবেক এমপি এম এ লতিফ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। সরকারের পট পরিবর্তনের ফলে এখন মুখ খুলেছেন সেই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. সেলিম। সাবেক শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বার বার ঊর্ধ্বতনদের কাছে ধরনা দিয়েও সুবিচার পাননি ‘ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেল’ জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের সি সাইড মেরিন লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি অভিযোগ করেন, ঋণের বিপরীতে বন্ধক থাকা জাহাজটি তাকে না জানিয়েই নিলামে বিক্রি করে ইস্টার্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

সি সাইড মেরিন লিমিটেড ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিমের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে আট কোটি টাকা সিসি আকারে ঋণ অনুমোদন দেয় ইস্টার্ন ব্যাংক। ২০১৯ সালে ক্রমবিয়োজিত ঋণের স্থিতি এক কোটি ৭১ লাখ টাকা হলে তা টার্ম লোন আকারে পরিশোধের জন্য সি সাইড মেরিন লিমিটেডকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি খেলাপিতে পরিণত হয়। মো. সেলিম বলেন, ২০১৯ সালের শেষ দিকে ইস্টার্ন ব্যাংক আমার ঋণটি টার্ম লোন আকারে নির্ধারিত কিস্তিতে পরিশোধ করতে বলে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বৈশ্বিক করোনা মহামারি শুরু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যবসায়িক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে ২০২০ সালেই করোনা মহামারির মধ্যে ঋণের বিপরীতে রাখা জাহাজটি আমাকে না জানিয়েই নিলামে তোলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের প্রভাবে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ‘ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেল’ নামের জাহাজটি নিলামে কিনে নেন তার ভাতিজা আবদুর নূর জাবেদ। তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালের শেষদিকে বিআইডব্লিউটিতে ডকুমেন্ট হালনাগাদ করার জন্য গেলে জানতে পারি জাহাজটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে। যখন জাহাজটি নিলামে তোলা হয় তখন সুদাসলে ঋণের স্থিতি ছিল এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা। যেখানে পাঁচশ টন ওজনের জাহাজটির স্ক্র্যাপের মূল্যই ছিল তিন কোটি টাকার উপরে। অথচ যোগসাজশ করে জাহাজটি মাত্র ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি দেয় ইস্টার্ন ব্যাংক। মো. সেলিম অভিযোগ করেন, পরবর্তীসময়ে ব্যাংকের সহযোগিতায় ওই সময়ের স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফের নির্দেশে একপ্রকার সন্ত্রাসী কায়দায় জাহাজটি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। তখন জাহাজে প্রায় দেড় কোটি টাকার ফার্নেস অয়েল ছিল। লতিফের কারণে আমি তখন কোনো সুবিচার পাইনি।

নিলাম জেতা মেসার্স জাস মেরিটাইমের কর্ণধার আবদুর নূর জাবেদের ব্যবস্থাপক এস এম মনজুর আলমের দেয়া তথ্যমতে, নিলামে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এতে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান ছিল মেসার্স জাস মেরিটাইম, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স শাহ আমানত মেরিন সার্ভিস এবং তৃতীয় দরদাতা ছিল আল নূর করপোরেশন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেসার্স জাস মেরিটাইম ৫০ লাখ দুই হাজার টাকা, মেসার্স আল নূর করপোরেশন ৩৯ লাখ এবং মেসার্স শাহ আমানত মেরিন সার্ভিস ৩৮ লাখ টাকায় জাহাজটির নিলাম ডাকে। এর মধ্যে জাস মেরিটাইম ও শাহ আমানত মেরিন সার্ভিস প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ভাতিজা আবদুর নূর জাবেদ।

নিলামে ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইস্টার্ন ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশনস অ্যান্ড এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স জিয়াউল করিম। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে জাস মেরিটাইম জাহাজটি কিনে নেয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেসার্স জাস মেরিটাইম এবং মেসার্স শাহ আমানত মেরিন সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী আবদুর নূর জাবেদ বলেন, আমি অসুস্থ। আমার ম্যানেজার মনজু বিষয়টি জানেন। মনজু এ বিষয়ে কথা বলবেন।

বার বার ঊর্ধ্বতনদের কাছে ধরনা দিয়েও সুবিচার পাননি ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেলের মালিক চট্টগ্রামের সি সাইড মেরিন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম। তার অভিযোগ, ঋণের বিপরীতে রাখা জাহাজটি তাকে না জানিয়েই নিলামে বিক্রি করে ইস্টার্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে এস এম মনজুর আলম বলেন, প্রথমবার নিলামে কেউ অংশ নেননি। দ্বিতীয়বার নিলামে অংশ নিয়ে ৫০ লাখ ২ হাজার টাকায় আমরা (জাস মেরিটাইম) জাহাজটি কিনেছি। জাহাজটি নতুন করে আমাদের নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, শাহ আমানত মেরিন সার্ভিসের নামে আমরা জাহাজটির কিছু ডিসটেন্সে (ব্যবধানে) দর দিয়েছিলাম। তবে আল নূর করপোরেশন কত দিয়েছিল জানি না।
‘ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেল’ জাহাজটির নিলামে অংশ নেয়া তিন প্রতিষ্ঠানের একটি মেসার্স আল নূর করপোরেশন। কিন্তু ইস্টার্ন ব্যাংকের ওই জাহাজ নিলাম সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাংকার সাপ্লাইয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও আল নূর করপোরেশনের অংশীদার মোহাম্মদ নূরুল হোসেন বলেন, আমরা ইস্টার্ন ব্যাংকের কোনো নিলামে অংশ নিইনি। ওটি নিউ সি কুইন এক্স ভেসেলের বিষয়েও কিছু জানি না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিলাম বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী, ৫০ লাখ টাকা অধিক দরের হিসেবে ১০ শতাংশ জামানত দিয়ে নিলামে অংশ নেয় জাস মেরিটাইম। তবে অবশিষ্ট টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করেনি নিলামগ্রহীতা। প্রায় এক বছরের বেশি সময় পরে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ৪০ লাখ ১ হাজার ৮০০ টাকার পে-অর্ডার জমা দেন নিলামগ্রহীতা।

যোগসাজশ করে কম দামে জাহাজ নিলামে বিক্রি করে দেয়া নিয়ে ঋণগ্রহীতার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার স্পেশাল এসেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ওই সময়ের সিনিয়র রিলেশনসিপ ম্যানেজার সিবেশ কুমার দাশের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা দেয়া হলেও কোনো সাড়া দেননি। পরে যোগাযোগ করা হলে ইস্টার্ন ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশনস অ্যান্ড এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স জিয়াউল করিম বলেন, সি সাইড মেরিন ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। তিনি খেলাপি হওয়ায় আদালতের নির্দেশে ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ হিসেবে থাকা জাহাজটি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। ব্যাংকিং আইন এবং যাবতীয় নীতিমালা অনুসরণ করেই নিলাম সম্পাদন করা হয়েছে। এখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

তবে নিলামে অংশ নেয়া তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটিই নিলাম জেতা একই মালিক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিলামে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে একই মালিকের একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে কি না- এটা পর্যালোচনা করার দায়িত্ব ব্যাংকের নয়।

 

ভোরের আকাশ/রন