logo
আপডেট : ২১ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:০১
ঢাবির প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
সাংবাদিকতা ও নারী জাগরণের অগ্রদূত
বিপুল জামান

সাংবাদিকতা ও নারী জাগরণের অগ্রদূত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, নারী শিক্ষাব্রতী ও নারী আন্দোলনের নেত্রী লীলা নাগের জন্মদিন আজ । লীলা নাগের জন্ম ১৯০০ সালের ২১ অক্টোবর ভারতের আসামের গোয়ালপাড়ায়। তার পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাধে চাকরি সূত্রে লীলা নাগের পরিবার আসামের বাসিন্দা হয়। তার মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন গৃহিণী।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আসামের দেওগর বিদ্যালয়ে লীলা নাগের শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে দুবছর অধ্যয়নের পর ভর্তি হন কলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে। এরপর তিনি ঢাকার ইডেন স্কুল থেকে ১৫ টাকা বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯২১ সালে বিএ পাস করেন। এই পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ওই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অর্থাৎ সহশিক্ষা চালু ছিলো না।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. রবার্ট হার্টস লীলা নাগের মেধার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ইংরেজি বিষয়ে মাস্টার্স শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেন।

তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিখ্যাত বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে লীলা নাগের পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন।

১৯২১ সালে তিনি নিখিলবঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটির সহসম্পাদিকা হন। এরপর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএতে ভর্তি হন।

১৯২৩ সালে ঢাকায় ‘দীপালি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘের উদ্যোগে প্রথমে ১২টি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরে নারী শিক্ষামন্দির নামে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘শিক্ষা ভবন’, ‘শিক্ষা নিকেতন’ ও ‘দীপালি স্কুল’ নামে আরও তিনটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

পারিবারিক প্রেরণা থেকেই তিনি নিজেকে বিপ্লবী কর্মে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি একটি বিপ্লবী দলে যোগ দেন। এরপর তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে নারী নিগ্রহ প্রতিহত করতে ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ গঠন করেন।

তিনি ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি লিখে পত্রিকাটির এই নাম দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে একটি কবিতাও পাঠিয়েছিলেন।

লীলা নাগের ছিল নানামুখী প্রতিভা এবং কর্মস্পৃহা। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক, বিপ্লবী, সম্পাদক, লেখক, নারীশিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত। এসব কারণেই লীলা নাগ সে সময়ে পরিচিত ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী পরিচয়টিও সামনে আসে। কালক্রমে লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে স্মরিত হতে থাকেন যদিও তার জীবন ও সংগ্রামের সমগ্রতার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।

পূর্ববঙ্গে নারীশিক্ষা বিস্তারে লীলা নাগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। শিক্ষাজীবনেই তিনি নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার সংগঠনে কাজ শুরু করেন। তিনি এই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন জনসভার আয়োজন করেন। এসব জনসভা আয়োজনের সময় তিনি লক্ষ্য করেন নারীদের সামাজিক মর্যাদাহীনতা ও অর্থনৈতিক অধিকার না থাকার কারণ হলো তাদের শিক্ষার অভাব। এরপর তিনি নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ‘দীপালি সঙ্ঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘের সদস্যদের নিয়ে ‘দীপালি স্কুল’ ও বারোটি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

নারীশিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলাও দীপালি সঙ্ঘের অন্যতম কাজ ছিল। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো বিপ্লবীও তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। ১৯২৭-২৮ সালের বিক্ষুব্ধ সময়ে নারীরা যখন শারীরিক আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছিলেন তখন লীলা নাগ মহিলা আত্মরক্ষার জন্য একটি দল গঠন করেন, যা ছিল মার্শাল আর্ট পদ্ধতিতে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিত।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের সময় তার ওপর নারী আন্দোলনের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯৩১ সালের মে মাসে ‘জয়শ্রী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিয়ের পরে তার রাজনৈতিক জীবনে নতুন গতি আসে। ফরোয়ার্ড ব্লক গঠিত হলে তিনি এই সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪০ সালে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে কারারুদ্ধ হন। কারামুক্তির পর সুভাষচন্দ্রের নির্দেশে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিকের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে নেতাজির অন্তর্ধানের পর তিনি ও অনিল রায় উত্তর ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনের দায়িত্ব নেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বাংলা থেকে ভারতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ভারতীয় শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরিতে অবদান রাখেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গা ও নোয়াখালী দাঙ্গার পর তিনি নোয়াখালীতে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করেন। ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ নামক একটি জনকল্যাণমূলক সংগঠনও তিনি স্থাপন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ ও সক্রিয় জীবনযাপন করেন।

লীলা নাগ জয়শ্রী পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে নারী জাগরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এ পত্রিকাটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে নারীদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং নারীদের লেখাই প্রকাশ করত। রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার ভূয়সী প্রকাশ করেছেন। তিনি দীপালি সঙ্ঘেরও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, এমন (দীপালি সঙ্ঘের) সংগঠন এশিয়ায় দ্বিতীয়টি দেখিনি।

বাংলার নারী জাগরণের এক উজ্জ্বল অধ্যায় লীলাবতী নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহশিক্ষা প্রচলনের পথিকৃৎ, নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার সুদক্ষ কারিগর ও একজন ইতিহাস প্রণেতা। তার সংগ্রামময় জীবন উত্তর প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবী কাজে যুক্ত থাকার অপরাধে ১৯৩০ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দী ছিলেন লীলা নাগ। দেশভাগের পর তিনি ভারতে চলে যান। এই মহীয়সী নারী সেখানেই ১৯৭০ সালের ১১ জুন মারা যান।

লেখকঃ সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন