আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদান না হওয়ায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ দিনদিনই যে বড়েছে সেকথা আর বলা অপেক্ষা রখেনা। এতে করে জনদুর্ভোগ যেমন বাড়ছে তেমনি শিল্প কারখানায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এই পরিস্থিতিতে যদি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদ্যুতের বিল অনাদায়ী পড়ে থাকে তাহলে সরকারি এই জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানটিতে যে অচলাবস্থা ভয়াবহ রূপ নিবে সেই আশঙ্কার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এমতাবস্থায় বিদ্যুতের দাম ও লোডশেডিং বাড়ার কারণে জনদুর্ভোগ দিনদিন বাড়বে বই কমবে না। বলা চলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতটিতে সমস্যা দিনদিনই প্রকট হবে। এক সময় সরকারের পক্ষেও তা সুরাহা করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ খাতে সেই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল এসংক্রান্ত বিষয়ে দৈনিক ভোরের আকাশে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বকেয়া ৪২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্টীয় সংস্থাটি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে লুটপাট, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে তৈরি হওয়া এ বকেয়ার পাহাড় চিন্তার ভাঁজ তৈরি করছে অন্তর্বর্তী সরকারের কপালেও। ইতোমধ্যে আর্থিক সংকটে বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানির সরবরাহ ধরে রাখা নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে বলেও আমরা মনে করি।
বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বেসুমার অর্থ খরচ করার পর দেশের মানুষের ঘাড়ে অতিরিক্ত বিল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছরই কয়েক দফা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে করে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ইত্যাদি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমরা সম্পূর্ণভাবে পিছিয়ে আছি। ফলে পিডিবির ওপর বাড়ছে চাপ।
দেশে প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যার অর্ধেক প্রয়োজন পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সামনের দিনে এ খরচের পরিমাণ আরও বাড়বে, কিন্তু সে জন্য মিলছে না প্রয়োজনীয় অর্থ। প্রয়োজন মতো কয়লা, এলএনজি ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে বাড়ছে লোডশেডিং। প্রভাব পড়ছে শিল্প কারখানাসহ অন্যান্য খাতেও। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৪৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৯১টি কারিগরি জটিলতা, জ্বালানি সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। ফলে বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এখন গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে বিপিডিবির বকেয়ার পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) পাওনা সাত হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ গ্যাস বিল ১৭ হাজার কোটি টাকা, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল ১০ হাজার কোটি টাকা, আদানি গ্রুপসহ ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাতের পাওনা রয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। এ সংকটের প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। জ্বালানি সংকটের ফলে ব্যাপক মাত্রায় লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগে পড়ছে জনজীবন।
আমরা মনে করি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে হলে বিদ্যুতের এই বকেয়া বিল আদায়ে নিতে হবে পরিকল্পিত উদ্যোগ। এই বিপুল পরিমাণ টাকা বিদ্যুৎবিল বকেয়া রেখে এই সরকারি সংস্থাটিকে সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই এব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে যেগুলোর তাপীয়-দক্ষতা ভালো, সেগুলো সচল রাখার পরিকল্পনা দরকার। ঘাটতি পূরণে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হবে। অষ্টম মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে নবায়নযোগ্য থেকে। অন্যান্য পরিকল্পনায় দেখা যায় ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কাজেই এই বিষয়টি মাথায় রেখে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে সরকার জোরালো উদ্যোগ নিবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন