চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা রিগান উদ্দীন। উন্নত জীবনের আশায় ইতালিতে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করেন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ওয়ার্ক পারমিট পান, যা এনওসি-নুলাওস্তা নামে পরিচিত। তবে সাত মাস ঘুরেও ঢাকায় ইতালি দূতাবাসের এজেন্ট ভিএফএস গ্লোবালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাননি। ফলে এখনো জমা দিতে পারেননি সম্পূর্ণ ফাইল। রিগান উদ্দীন বলেন, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর অ্যাম্বাসিতে ফাইল জমা দিতে পারছি না। ফাইল জমা হলে এরপর যাচাই-বাছাই করে ইতালি কর্তৃপক্ষ ভিসা দেয়। অনেকে ফাইল জমা দিয়ে এখনো ভিসা পায়নি। আমি কবে ফাইল জমা দিতে পারবো সেটিই জানি না। এখন বেকার। কোনো কাজ নেই। অন্য কোনো দেশেও যেতে পারছি না।
শুধু রিগান উদ্দীন নন, এভাবে বাংলাদেশের এক লাখ ১০ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী ইতালি থেকে ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তাদের মধ্যে পাসপোর্টসহ ফাইল জমা দিতে পেরেছেন ৪০ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী। বাকিরা ফাইলই জমা দিতে পারেননি। ইতালি গিয়ে উন্নত জীবনের যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, তা যেন তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে ফিরে এসেছে। বলা যায়, স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতালি থেকে যেসব ওয়ার্ক পারমিট এসেছে তার একটি বিশাল সংখ্যক ভুয়া। অভিবাসনপ্রত্যাশীর কাছ থেকে দালাল বা এজেন্সিগুলো বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিলেও প্রকৃত কোনো ডকুমেন্ট আনতে পারেনি। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সেই অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে জাল কাগজপত্র। দূতাবাসে জমা হওয়ার পর জাল কাগজের বিষয়টি ধরতে পেরেছে ইতালির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ কারণেই আটকে দেয়া হয়েছে ইতালিতে কর্মী নেয়ার প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইতালি থেকে ঠিক কতজনের ওয়ার্ক পারমিট এসেছে এবং তাদের মধ্যে কতগুলো আসল বা নকল, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। এখন অসাধুচক্রের কারণে বেকায়দায় পড়েছেন সবাই।
গত কয়েক বছরে গণহারে মালয়েশিয়ার ভিসা ইস্যু হওয়া নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, একই অবস্থা দাঁড়াতে যাচ্ছে এবার ইতালির ক্ষেত্রে। মালয়েশিয়ার ভিসা হাতে পাওয়ার পরও যেমন ১৭ হাজারের বেশি কর্মী যেতে পারেননি, টাকাও ফেরত পাননি; একই রকম পরিস্থিতি এবার হতে পারে ইতালির ক্ষেত্রে। দেশটি যে প্রক্রিয়া আটকে রেখেছে তা যদি গুরুত্ব দিয়ে যথাযথভাবে সমাধান না করে তাহলে কয়েক লাখ টাকা খরচ করার পরও আটকে যাবেন প্রকৃত ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। আবার যারা কয়েক লাখ টাকা খরচ করার পর ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন, তাদের সর্বনাশ এরই মধ্যে হয়ে গেছে।
অভিবাসনপ্রত্যাশী ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর তিন মাসের চেষ্টায় ফাইল জমা দিতে পেরেছি। এখন চার মাস হয়েছে। ভিসা হবে কিনা, ফলাফল কবে পাবো, জানি না। অথচ ইতালি সরকারের এসব ফাইল তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা। ওয়ার্ক পারমিট আনাসহ এ পর্যন্ত সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ঢাকায় একটি দোকানে ক্যাশিয়ার হিসেবে আপাতত আছি। ভিসা না হলে সব মাটি হয়ে যাবে। এমন অবস্থায় আছি, অন্য কোনো দেশেও যেতে পারছি না। হাতে পাসপোর্ট নেই।
জানা গেছে, ইতালি সরকারের ঘোষিত ইমিগ্রেশন ডিক্রি ২০২৩-২০২৪-২০২৫ অনুযায়ী, নির্ধারিত বিদেশি কর্মী নেয়ার কোটা ছিল ৪ লাখ ৫২ হাজার। এর অধীনে ওয়ার্ক পারমিট আসে। যাদের ওয়ার্ক পারমিট আসে তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার আবেদন ইতালি দূতাবাসের ভিসা প্রসেসিং এজেন্ট ভিএফএস গ্লোবালে জমা করা হয়েছে। এই আবেদনগুলোর কোনো কোনোটি ৫-৬ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে ফলাফলের জন্য অপেক্ষমাণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাদের ফাইল জমা হয়ে আছে তারা পড়েছেন মূল সমস্যায়। একদিকে তারা ভিসার আশায় বিনিয়োগ করেছেন কয়েক লাখ টাকা। অন্যদিকে পাসপোর্ট হাতে না থাকায় অন্য কোনো দেশেও যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। এদের অনেকেই আবার আগে অন্য কোনো দেশে অভিবাসী কর্মী ছিলেন। ধনী দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে এখন তারা দুকূলই হারিয়েছেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইতালির অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ মাইগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট ফোরামের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২৩ সালে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েও আজ প্রায় দুই বছর হয়ে যাচ্ছে, তারা ভিসা পাননি। দূতাবাসের সব নিয়ম মেনে পাসপোর্ট ও ডকুমেন্টস জমা দিয়েছেন। এখন পাসপোর্টও ফেরত পাচ্ছেন না। আবেদন বাতিল করে অন্য কোনো দেশেও যাওয়ার সুযোগ নেই। পারিবারিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তাদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে এসেছেন ফাইল জমা দিতে। কিন্তু তাদের ফাইল নিষ্পত্তি না হওয়ায় পাসপোর্ট আটকে আছে। পুনরায় মধ্যপ্রাচ্যেও ফেরত যেতে পারছেন না। একেকজন অভিবাসী দেশে ফিরে ১২ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, ২০১২ সালে ইতালির শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। আট বছর পর ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে অবৈধ ইমিগ্রেশন প্রতিরোধে ইতালি ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি সই করা হয়। ফলে আবারও ইতালির স্পন্সর সিস্টেম তথা ইতালি সরকারের ঘোষিত ইমিগ্রেশন ডিক্রির আওতায় বাংলাদেশি কর্মী নেয়া শুরু করে ইতালি।
এ বিষয়ে প্রবাসী উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ তাইফুর রহমান বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশিদের প্রায় ছয় লাখ আবেদন রেজিস্ট্রেশন করা হয়। যার মধ্য থেকে এক লাখের বেশি আবেদন অনুমোদন হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদিও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নকল ওয়ার্ক পারমিট আছে। এ কারণেই ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়াটি ঢাকার ইতালি দূতাবাসের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি সই হওয়ার পর এসব পরিস্থিতির দায় বাংলাদেশের সদ্য সাবেক সরকার এড়াতে পারে না। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে ইতালি ও ইউরোপে প্রতি বছর এক কোটি শ্রমিক ঘাটতির বাজারে অপরিসীম সুযোগ নেয়া সম্ভব।
ইউরোপীয় অভিবাসনবিষয়ক সমন্বয়ক ও বিএমডিএফ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জয় বলেন, ইতালি দূতাবাসে জমা করা পাসপোর্ট ও ভিসাপ্রত্যাশীদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা রেমিট্যান্সযোদ্ধা। মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শরীরের ঘাম ঝরানো টাকা বিভিন্ন এজেন্টের হাতে তুলে দিয়েছেন স্বপ্ন পূরণের আশায়। তাদের সব অনিশ্চয়তা বন্ধ করতে হবে। দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে হবে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সরোয়ার আলম বলেন, ইতালির এ সংকট অনেক দিনের। পাসপোর্ট জমা দিয়ে ভিসা নিষ্পত্তি না হওয়ায় মানুষ বেকার অবস্থায় রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারা। আমরা এ বিষয়ে সমাধানের ব্যাপারে তাদের অ্যাম্বাসিকে জানিয়েছি। যদিও ভিসা দেওয়া না দেয়া তাদের ব্যাপার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা জানতে পেরেছি এক লাখ বা যত জনই ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ও ইতালির একটি চক্র ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট বানিয়েছে। অ্যাম্বাসি এগুলো যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এরপর থেকে ফাইল জমা নেওয়া বন্ধ। ফাইলসহ যেসব পাসপোর্ট জমা নেয়া আছে সেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ কারণে যারা লিগ্যাল ডকুমেন্টস দিয়েছে তারাও এখন হয়রানির শিকার। পাসপোর্ট জমা দিয়ে তারা অন্য কোনো দেশে যেতে পারছেন না।
এ নিয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ঢাকায় ইতালির দূতাবাস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তার মতোই দূতাবাস জানিয়েছে, ভুয়া ওয়ার্ক পারমিটের জন্যই পুরো প্রক্রিয়াটি আটকে ছিল। এখন ক্রমান্বয়ে সব পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হবে। দূতাবাস বলেছে, বিপুল সংখ্যক জাল নথি বা ডকুমেন্টের কারণে ইতালি সরকার ১১ অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের অনুকূলে ইস্যুকৃত সব কর্ম অনুমোদনের বৈধতা স্থগিত করেছে, যা যথাযথ যাচাইকরণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ইতালির প্রভিনশিয়াল ইমিগ্রেশন অফিস থেকে নিশ্চিতকরণের পরে স্থগিত করা কর্ম অনুমোদনের যাচাইকরণ সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে ইতালি দূতাবাস কর্ম ভিসা ইস্যু করবে। উপরে উল্লিখিত যাচাইকরণ মুলতবি থাকা আবেদনকারীদের পাসপোর্ট ক্রমান্বয়ে ফেরত দেয়া হবে। ফেরত প্রদানের কার্যক্রম ২০ অক্টোবর ২০২৪ থেকে শুরু করা হবে। এসএমএস অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে প্রতিটি আবেদনকারীর সঙ্গে ভিএফএস গ্লোবালের মাধ্যমে পাসপোর্ট ফেরত দানের জন্য যোগাযোগ করা হবে।
দূতাবাস আরও জানিয়েছে, আবেদনকারী, নিয়োগকর্তা এবং আইনজীবীদের তাদের কর্ম অনুমোদন যাচাইকরণের জন্য দূতাবাসে এবং ভিএফএস গ্লোবালে ইমেইল না পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেয়া যাচ্ছে। কারণ যাচাইকরণের সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি ইতালিতে সম্পন্ন হয়। কর্ম অনুমোদনের ধারকরা প্রয়োজনে ইতালিতে সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে তাদের কর্ম অনুমোদনের যাচাইকরণ সম্পর্কে আপডেট পেতে যোগাযোগ করতে পারেন।
ভোরের আকাশ/রন