আজীবন সাম্যের কথা বলে বামধারার রাজনীতি করেছেন কেউ কেউ। আবার কেউ ধর্মকে পুঁজি করে দরবারকেন্দ্রিক জীবন কাটিয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাদের কারও ক্ষমতার কাছাকাছি আসার তেমন সুযোগ হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে একাধিক নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর হয়েছেন সংসদ সদস্য। বিনাভোট, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়ে ক্ষমতার পুরো স্বাদ নিয়েছেন এসব রাজনীতিবিদ। ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরো সময়ে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অবৈধ অর্থ উপার্জন করে একেকজন বনে গেছেন টাকার কুমির।
তাদেরই একজন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, যাকে বামধারার রাজনীতিকদের মধ্যে শীর্ষ নেতা হিসেবে ধরা হয়। তার দলেরই সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে হয়েছেন একাধিকবারের এমপি। এই দলে আছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের আরেক নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারির আছেন সম্পদের পাহাড় তৈরির তালিকায়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে আখ্যা পাওয়া জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুরাও সম্পদ বানাতে পিছপা ছিলেন না। নির্বাচনি হলফনামা ও দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের এক নির্বাচন থেকে অন্য নির্বাচন পর্যন্ত সম্পদ বেড়েছে বহুগুন। তাদের মধ্যে হাসানুল হক ইনুর দশ বছরের ব্যবধানে নগদ টাকা ৫২গুণ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদে এসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করা শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিপদে পড়তে শুরু করেছেন এসব নেতারা। গ্রেপ্তার হয়ে এদের কারও দিন কাটছে কারাগারে। গ্রেপ্তার এড়াতে কেউ আছেন আত্মগোপনে। আর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার মসনদে টিকে রাখার মিশনে পাশে থাকা জাতীয় পার্টির নেতাদের দিন কাটছে আতঙ্কে!
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধ সম্পদ অর্জন করা নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাশেদ খান মেননের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর এবার প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছে দুদক। গত ২২ আগস্ট বিকেলে গুলশানের বাসা থেকে রাশেদ খান মেননকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন তিনি। মুখে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বললেও রাশেদ খান মেনন সম্পদ বানানোর ক্ষেত্রে পুরো উল্টোপথে হেঁটেছেন। কখনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে, কখনো বা সংসদ সদস্য হিসেবে রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দলের এই নেতা রমনা, মতিঝিল ও সবুজবাগ থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। ছিলেন সমাজ কল্যাণমন্ত্রী এবং বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিগত ১৬ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অভিযোগ আছে, রাশেদ খান মেনন লন্ডনে ২৫টি বাড়ি কিনেছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৮ হাজার কোটি টাকা। কানাডায় ৫টি বাড়ি কিনেছেন তার স্ত্রীর নামে। যার মূল্য প্রায় ১২০ কোটি টাকা এবং আমেরিকায় দুটি বাড়ি ও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার রয়েছেন তার। এছাড়া ঢাকার গুলশানে ২৫ কোটি টাকার ৪টি ফ্ল্যাট, বানানীতে ৯ কোটি টাকার ২টি ফ্ল্যাটসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হাজার বিঘা জমির মালিকানা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নিজ ও আত্মীয় স্বজনের নামে দেড় হাজার কোটি টাকা ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মেনন ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননেছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি হিসেবে অবৈধভাবে শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ১৮২ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রায় ১৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবৈধভাবে পদোন্নতি দিয়ে প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগও আছে মেননের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে বিভিন্ন খাতে ভুয়া ভাউচারে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মেনন চক্র। অন্যদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকেও বিপুল টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন সাবেক এই সংসদ সদস্য।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা নৌকাপ্রতীক নিয়ে নির্বাচনি ট্রেন পার করেছেন। সমঝোতার ভোটে এমপিও হয়েছেন। নির্বাচনি হলফনামায় নিজের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের কাছাকাছি থাকার সময়ে তার স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ও নগদ অর্থ বেড়েছে। নির্বাচনি হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিল করা হলফনামা বাদশা তার ব্যাংক হিসাবে দেখিয়েছিলেন ২৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮শ টাকা। সবশেষ নির্বাচনের হলফনামায় ব্যাংকে এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ২৪৫ টাকা আছে বলে তথ্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ শেষ পাঁচ বছরে তার টাকার পরিমাণও পাঁচগুণ বেড়েছে। আগে বাদশার সাড়ে ১৬ লাখ ও ৩৮ লাখ টাকার দুটি গাড়ি থাকলেও এখন একটি জিপের দামই ৭০ লাখ। আগে দোকান ভাড়া থেকে কোনো আয় না থাকলেও সবশেষ নির্বাচনে মার্কেট ভাড়া থেকে বছরে আয় দেখিয়েছেন ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮২৩ টাকা।
দশ বছরে ইনুর নগদ টাকাই বেড়েছে ৫২ গুণ। নির্বাচনি হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ইনুর কাছে নগদ টাকা ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার। সবশেষ নির্বাচনে তিনি দেখিয়েছেন তার কাছে নগদ টাকা আছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ১৫৫ টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৫২ গুণ। স্ত্রী আফরোজা হকেরও নগদ টাকা বাড়ার তথ্য নিজেই দিয়েছেন তিনি। কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন ইনু। সবশেষ নির্বাচনে ভোটে হেরে তার আর সংসদে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বিগত সময়ে একবার তথ্যমন্ত্রীও ছিলেন। তথ্য অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইনুর স্ত্রীর নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯০ টাকা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় ছিল ৬০ লাখ ৩ হাজার ২৫৮ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে তা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৩ টাকায়। সবশেষ নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্য মতে, ইনুর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯২৪ টাকা; এই খাতে ৫ বছর আগে ছিল ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ৪৮০ টাকা। ১০ বছর আগে ছিল ৩৬ লাখ ৭০ হাজার ১৫৬ টাকা।
সম্পদ বাড়াতে পিছিয়ে নেই নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারিও। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত দশ বছরে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারির বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে সাত গুণ বেড়েছে। একই সময়ে তার স্ত্রীর আয়ও বেড়েছে তিন গুণ। এর পাশাপাশি ২০১৪ সালের আগে নজিবুল বাশারের স্ত্রী ও তার দুই ছেলের কোনো গাড়ি ছিল না। এখন তারা চারটি গাড়ির মালিক। নজিবুল নিজেও ব্যবহার করেন দুটি গাড়ি। নজিবুল বশর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরপর দুইবার চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা না পেয়ে নিজের দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও পরে ভোট থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায় নজিবুল বশর তার বার্ষিক আয় দেখিয়ে ছিলেন সাত লাখ ২৬ হাজার ৫৩৫ টাকা। ২০২৩ সালের হলফনামায় এই আয় দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬২৭ টাকা। নজিবুলের এই আয় তার ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখানো আয়ের চেয়ে দেড়গুণ বেশি। সে সময় তিনি তার আয় দেখিয়েছিলেন ৩৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ টাকা। এছাড়া দশ বছর আগে নজিবুলের স্ত্রীর বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ ৮২ হাজার ৪২০ টাকা। দ্বাদশ নির্বাচনে তার আয় দেখানো হয়েছে আট লাখ ৮২ হাজার ৩১৬ টাকা। তথ্য অনুযায়ী, দশ বছরে নজিবুলের অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণও বেড়েছে তিন গুণ। বেড়েছে নগদ টাকার পরিমাণও। ২০১৪ সালের আগে নজিবুল বাশারের স্ত্রী ও তার দুই ছেলের কোনো গাড়ি ছিল না। এখন তারা চারটি গাড়ি ব্যবহার করেন। নজিবুল নিজেও ব্যবহার করেন দুটি গাড়ি।
মহাজোটের শরিক নেতারা যখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান তখন সংকটে আওয়ামী লীগের পাশে থাকা জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মুজিবুল হক চুন্নুও সম্পদ অর্জনে অনেক এগিয়ে গেছেন। কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের পাঁচবারের এই সংসদ সদস্যের জাতীয় নির্বাচন করেছেন শুভাকাক্সক্ষী ও আত্মীয়দের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। কিন্তু সেই চুন্নু এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যেই গণমাধ্যমকে এসব তথ্য দিচ্ছেন। করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শামীম আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, ২০০১ সালে নির্বাচন করতে কিশোরগঞ্জ শহরের একটি বাড়ি ও দুটি বাস বিক্রি করেছিলেন চুন্নু। কিন্তু ২০০৮ থেকে সবশেষ নির্বাচন পর্যন্ত এমপি হয়ে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কানাডায়ও তার একটি বাড়িও রয়েছে গুঞ্জন আছে। গত ১৫ বছরে চুন্নুর নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা বেড়েছে ৩৭ গুণ। আর তার স্ত্রীর বেড়েছে প্রায় চার গুণ। হলফনামা অনুযায়ী, চুন্নুর বর্তমান পেশা আইনজীবী, পাশাপাশি রয়েছে ব্যবসা। ২০০৮ সালে তার পেশা ছিল কেবল আইনজীবী। তবে সে সময় তার একটি বাস ছিল। ২০০৮ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের নামে জমা ছিল ৪ লাখ ২৪ হাজার, আর স্ত্রীর নামে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া তার নগদ ছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার, স্ত্রীর ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭২৪ টাকা। অর্থাৎ ২০০৮ সালে চুন্নুর ছিল ৯ লাখ ২২ হাজার ২৯০ এবং স্ত্রীর ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৭০৯ টাকা। বর্তমানে চুন্নু ৩ কোটি ৪১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৩ ও স্ত্রী ১১ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৪ টাকার মালিক।
ভোরের আকাশ/রন