logo
আপডেট : ২৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:৪৮
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রের হদিস ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বিতর্ক
আমীন আল রশীদ

প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রের হদিস ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বিতর্ক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না এবং এটি নিয়ে এখন তুলকালাম চলছে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাস পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের হদিস নিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত মূলত মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকার—যেখানে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনও দালিলীক প্রমাণ তার (রাষ্ট্রপতি) কাছে নেই।প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেটি কিছু সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

যেমন:
১. শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র কোথায়?
২. এই ইস্যুতে কেন এখন রাষ্ট্রপতিরও পদত্যাগের দাবি উঠছে?
৩. রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি এই বিতর্কটি উসকে দেওয়া হলো?
৪. রাষ্ট্রপতিকে যদি পদত্যাগ করতে হয় তাহলে তিনি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? কেননা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয় স্পিকারের কাছে। কিন্তু এ মুহূর্তে স্পিকার নেই। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে।
৫. রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন?
৬. রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন? কেননা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয় সংসদে। এখন সংসদও নেই।
৭. যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন এবং কাউকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা না যায় তাহলে এই শূন্যতা পূরণ হবে কী করে? বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের অনেক কাজই করতে হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি না থাকলে সেই কাজগুলো কীভাবে হবে?
৮. অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করবেন? যদি তাই হয়, তাহলে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় বা সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদবলে রাষ্ট্রপতি হবেন , কে তাকে নির্বাচিত করবে?

প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওইদিন রাতেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন: ‘আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’ (প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০২৪)।

কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তিনি শুনেছেন যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তার কাছে এর কোনও দালিলিক প্রমাণ নেই। বলেন, পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করার বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।

যদি তাই হয় তাহলে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি কেন বললেন যে, শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি? তিনি কি ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মুখে ওই কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন?

মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিনা? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর।’

তার মানে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি যখন ভাষণ দেন, তখনও তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি বলেছেন মূলত অন্যদের কাছে থেকে শুনে। তার কাছে কোনও পদত্যাগপত্র আসেনি। যদিও তিনি ভাষণে বলেছেন যে, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৫৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেন। পদত্যাগের সঙ্গে ‘পত্র’ শব্দটি আছে মানে সেটি অবশ্যই লিখিত হতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র না থাকলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে কি না এই প্রশ্নটি তোলা যেমন সঙ্গত, তেমনি গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পতন হলে তখন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র আছে কি নেই; তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র দিলেন কি দিলেন না; তিনি সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র দিলেন নাকি ই-মেইল বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক উপায়ে দিয়েছেন; তিনি ফোনে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন কিনা এসবের আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কিনা, সেটি আরও বড় প্রশ্ন।

এরকম পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র না পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য শপথ ভঙ্গ করার শামিল।’ শপথ ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। একইদিন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে বলেছেন, না হলে বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনে লংমার্চ টু বঙ্গভবন কর্মসূচি ঘোষণা করবে।

যদিও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্র্বতী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

এবার প্রশ্ন হলো, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? সংবিধানের ৫০ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্পিকারের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি তার পদ ত্যাগ করতে পারবেন। এর বাইরে তাকে অভিশংসন বা অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু এখন সংসদ নেই। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। তার মানে রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ না করেন তাহলে তাকে সরানোর আইনি পথ নেই। আর যদি তিনি সরে যেতে চান, অর্থাৎ পদত্যাগ করতে চান তখন প্রশ্ন উঠবে তিনি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? কেননা এ মুহূর্তে স্পিকার নেই। সংসদ না থাকলেও স্পিকার পরবর্তী স্পিকার দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত তার পদে থাকতে পারেন। কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তিনিও গত ১৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন। তিনি এখনও পদত্যাগ করেননি। কিন্তু কারাবন্দী ডেপুটি স্পিকারের কাছে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, সেটি বাস্তবসম্মত নয়।

তাহলে এর সুরাহা হবে কী করে? সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনও সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এমন কোনও জন-গুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে যে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন এবং উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন। যে ঘটনাটি ঘটেছিল অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার ক্ষেত্রে। যেহেতু সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও বিধান নেই, ফলে এই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সেজন্য সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেছিলেন যে, জাতির এরকম ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা যেতে পারে। অতএব এবারও স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার ও সংসদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের প্রশ্ন উঠলে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া হবে।

এরপরে প্রশ্ন আসবে যে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কী হবে? ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কে হবেন? সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। আগেই বলা হয়েছে যে স্পিকার নেই, ডেপুটি স্পিকার থাকলেও তিনি কারাবন্দী। অতএব তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হবেন, তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং এ মুহূর্তে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পরে কোনও সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন।

কী হতে পারে? জনপরিসরে এই আলোচনাও আছে যে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই রাষ্ট্রপতি হয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করবেন। অর্থাৎ তখন আর অন্তর্বর্তী সরকার বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু সংবিধানে পরিবর্তন না এনে সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন করা যাবে কিনা, সেটি আরেকটি সাংবিধানিক প্রশ্ন। সুতরাং কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে, সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠলে তার মীমাংসার জন্য সুপ্রিম কোর্টেই যেতে হবে। কেননা একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে এবং এই সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছে, অতএব তারা চাইলেই এখন এই সংবিধানকে উপেক্ষা করে বিপ্লবী সরকারের আদলে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এটি করতে হলে তাদের শপথ গ্রহণের আগেই করতে হতো। অতএব যেসব সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠছে বা উঠবে সেগুলো সুরাহার জন্য আপতত সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদই ভরসা।

পরিশেষে, সংবিধান সংস্কারের জন্য অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার এই কমিশনের বা অন্তর্বর্তী সরকারের না থাকলেও তারা পরবর্তী সংসদের জন্য একটি প্রতিবেদন রেখে যেতে পারবে; সেখানে অভ্যুত্থান বা এরকম কোনও ঘটনায় সরকারের পতন হলে কিংবা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তার সুরাহা কী করে হবে, সংবিধানে তার সুস্পষ্ট বিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। কেননা ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা যে আর ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

লেখক: সাংবাদিক।

 

ভোরের আকাশ/রন