এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ এখন আর শুধু বর্ষা মৌসুমের রোগ নয়। ধরন বদলে বছরব্যাপী দেখাচ্ছে দাপট। এমনকি শীতেও ছড়াচ্ছে প্রকোপ। আগে রাজধানী ঢাকায় বেশি দেখা দিলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় শহরগুলোতেও। জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কমবেশি মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম ২৪ দিনেই সারাদেশে একশ ছাড়িয়েছে মৃত্যু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণে মারা গেছেন ২৬৮ জন। এখন পর্যন্ত একক বছরে মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এটা তৃতীয় সর্বোচ্চ। তবে বছরের বাকি দিনে তা কোন পর্যায়ে যাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৫৪ হাজার ২২৫ জন। চলতি বছর সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু দেখা যাচ্ছে অক্টোবরে এসে। অক্টোবরের প্রথম ২৪ দিনেই মারা গেছেন ১০৫ ন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ৮০ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আগস্টে ২৭, জুলাইয়ে ১২, জুনে ৮, মে মাসে ১২, এপ্রিলে ২, মার্চে ৫, ফেব্রুয়ারিতে ৩, জানুয়ারিতে ১৪ জন মারা যান।
কীটতত্ত্ববিদরা আগে থেকেই এবছর অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় উড়ন্ত মশা মারার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম দেখা মেলেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, আমি আগে বলেছিলাম সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। এ সংখ্যাটি হঠাৎ করে বাড়েনি। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসন এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ অবস্থায় অক্টোবরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে।
পুরুষরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হলেও বেশি মারা যাচ্ছেন নারীরা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ ও ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ নারী ও ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া নারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২১ থেকে ৩৫ বছরের নারীর মৃত্যু হয়েছে বেশি। ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত মোট নারীর মৃত্যু ১৪৩ জন। যার মধ্যে ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৪৯ জন। এ ছাড়া ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারী ২০ জন। এ ছাড়া পুরুষ-নারী মিলিয়ে এ বছর ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন। এই বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৬৩, আর মৃত্যু ৫৫।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. তাবিহা বিনতে হান্নান বলেন, গর্ভকালে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যে কারণে মৃত্যুহার অন্য রোগীর তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি থাকে। এ ছাড়া ঋতুস্রাবকালে কোনো নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ এই সময়ে রক্তচাপ অস্বাভাবিক কম থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। অন্যদিকে, মৃত্যু বেশি হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। উত্তর ও দক্ষিণে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা কাছাকাছি। উত্তর সিটি করপোরেশনে ১১ হাজার ৩১৪ জন এবং দক্ষিণে ১০ হাজার ৯৯৭ জন। দক্ষিণে মৃত্যু ১৩৩ জন। উত্তরে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ, সেখানে আক্রান্ত ৯ হাজার ৮২৬ জন, মৃত্যু ২৬ জনের। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ঢাকা বিভাগে মোট আক্রান্ত ৮ হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্ত ৯ হাজার ৮২৬ জন, মৃত্যু ২৬ জনের। বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত ৪ হাজার ৭০৪ জন, মৃত্যু ৩২ জনের। খুলনা বিভাগে আক্রান্ত চার হাজার ৬৫৩ জন, যার মধ্যে মারা গেছেন ১৬ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে ১ হাজার ৪৭২ জন আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। এছাড়া রংপুরে ৮৫৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৫০৭ জন ও সিলেট বিভাগে ১৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই তিন বিভাগে কেউ মারা যাননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় ২০২৩ সালে। ওই বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত সেপ্টেম্বরে এক মাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন। তবে চলতি বছর সেপ্টেম্বরে মারা যান ৮০ জন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুর জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৮১ জন।
ভোরের আকাশ/রন