রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। বিএনপি প্রথমে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সরব থাকলেও দলটি পরে ইউটার্ন নিয়েছে। সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দিলে নির্বাচন বানচাল ও সময়ক্ষেপণসহ নানা আশঙ্কায় বিএনপি হঠাৎ করেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিপক্ষে অবস্থায় নিয়েছে। আর বিষয়টি নিয়ে শুরুতে নীরব থাকলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্য কথা বলতে শুরু করেছে। দলটি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায়। এর আগে সরকার পতনের পর নির্বাচন প্রশ্নেও দল দুটির নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন- সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ এ পদে হঠাৎ করেই শূন্যতা চান না তারা। নানা আশঙ্কার কথাও বলছেন তারা। আর জামায়াত নেতারা বলছেন, স্বৈরাচারের সহযোগী রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে না।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় রাষ্ট্রপতির মো. সাহাবুদ্দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র হাতে পাননি। তিনি নিজেও পদত্যাগপত্র খুঁজছেন। এ সংবাদ প্রকাশের পর রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও শপথ ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে আল্টিমেটাম দেন। প্রথমে শহীদ মিনারে পরে বঙ্গভনের সামনেও সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেন, যা নিয়ে বঙ্গবভনের সামনে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় জনসাধারণের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
প্রথম দিকে বিএনপি নেতারাও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পক্ষে কথা বলেন। দলটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও গত ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেন। একদিন পর তিনিসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে বের হয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন- দেশে যাতে নতুন করে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয় সেজন্য খেয়াল রাখতে বলেছি। আমরা কোনো সাংবিধানিক সংকট চাই না। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যদি কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকামীরা তা প্রতিহত করব। একইদিন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আরেক ব্রিফিংয়ে বলেন, রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টি করবে। সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে। যেটা জাতির কাম্য নয়। এই সংকটের কারণে যদি জাতির গণতন্ত্রে উত্তরণ বিলম্বিত হয় বা বাধাগ্রস্ত হয়, সেটা জাতির কাম্য নয়। অথ্যাৎ, বিষয়টি নিয়ে দলটির ইউটার্ন নেয়।
এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ প্রসঙ্গে একটি পত্রিকায় রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে তা একটি সেটেলড ম্যাটার। বঙ্গভবন থেকে বিবৃতি দিয়েও তা বলা হয়েছে। তারপর এটা নিয়ে আর বিতর্ক থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে তার পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা ও রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হলে তৃতীয় পক্ষ বা অন্য কোনো পক্ষের দূরভিসন্ধি কাজ করবে কিনা। সেইরকম রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকটের মুখোমুখি আমরা হতে চাই না। আমরা চাই গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে অন্য কোনো কিছু যেন বাধা না হয়।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতিকে স্বপদে বাহাল রাখায় কোনো সংকট দেখছি না। বরং আমার দল মনে করে, তিনি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। কারণ, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। সংসদ নেই। তাহলে তিনি কোথায় পদত্যাগ করবেন? তিনি পদত্যাগ করলে সংকট হবে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই করতে হবে। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকে নীরব থাকলেও শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন জামায়াত ইসলামীর নেতারা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ চেয়ে গতকাল ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ চায়। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব মৌলিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী মনে করে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন সেটি নিরসনের দায়িত্ব তার নিজের। এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার কারণে তিনি এই মহান দায়িত্বে থাকার নৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়েছেন। এখন এই পদে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব থেকে চলে গেলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে না। তিনি বলেন, যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে সেভাবেই এই সংকটেরও সমাধান হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিস্টেমও সংবিধানে নাই। কিন্তু সংবিধানে না থাকা সত্ত্বেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স-এর মাধ্যমে সেটি সমাধান হয়েছে। তাই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে খুব বেশি জটিলতা আমি দেখি না।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের দেয়া পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সংস্কার কাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। আর জামায়াতের নেতারা বলেছেন, শহীদদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। তাই একটি সংস্কারের পর নির্বাচন চায় দলটি। তাদের বক্তব্য ছিল শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্যে হাজারো মানুষ জীবন দেয়নি। এবার শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইস্যুতেও দল দুটিতে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন