বৈষম্য শব্দটি সাধারণত বিভিন্ন মানুষের মধ্যে অসম আচরণ বা প্রাপ্তির পার্থক্য নির্দেশ করে। এটি এক ধরনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবিচার, যেখানে এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অন্যের তুলনায় কম মূল্যায়ন করা হয়। জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আজও বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটি শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিকগুলোকেও প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক‘ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুল শ্লোগান ছিল বৈষম্য’এর বিরোধীতা। বর্তমানে ‘বৈষম্য’ একটি ভাইরাল শব্দ। বৈষম্যের বিভিন্ন রুপ আছে। বৈষম্য এমন একটা শব্দ যার প্রয়োগ যুগে যুগে সব দেশেই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে অনুমেয়।
বৈষম্য’ এর শাব্দিক অর্থ এবং বিভিন্ন রুপ:
১। বৈষম্য (Discrimination): অসম আচরণ বা পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং কারও সাথে অন্যায্য বা ন্যায্যতার বাইরে গিয়ে ব্যবহার করা। অসম আচরণ বা পক্ষপাতমূলক আচরণ। যেমনঃ
কর্মক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক পদোন্নতি: একজন কর্মী অন্যদের তুলনায় কম যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা থাকার পরও শুধুমাত্র তার ম্যানেজারের প্রিয় হওয়ার কারণে পদোন্নতি পেয়ে যায়, যেখানে অন্যান্য যোগ্য কর্মীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক পক্ষপাতমূলক আচরণ: একটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক একজন ছাত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন এবং তাকে সবসময় ভালো নম্বর দেন, যখন অন্য ছাত্ররা সমানভাবে পরিশ্রম করলেও তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়।
নিয়োগে অসম আচরণ: একটি সংস্থায় নারী প্রার্থীদের চেয়ে পুরুষ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যদিও নারী প্রার্থীদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সমান বা অধিক থাকে।কারও সাথে অন্যায্য বা ন্যায্যতার বাইরে গিয়ে ব্যবহার করা।
বেতন বৈষম্য: একই কাজ এবং অভিজ্ঞতার জন্য একজন পুরুষ কর্মীকে বেশি বেতন দেওয়া হয়, কিন্তু একজন মহিলা কর্মীকে কম বেতন দেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণভাবে অন্যায্য এবং ন্যায্যতার বাইরে গিয়ে করা হয়।
নির্দিষ্ট প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাত: একটি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন একজন প্রার্থীকে বেছে নেওয়া হয় যার যোগ্যতা অন্য প্রার্থীর তুলনায় কম, শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পরিচিতি থাকার কারণে। এই আচরণটি অন্য প্রার্থীদের প্রতি অন্যায্য।
আইন প্রয়োগে বৈষম্য: কোনো আইনি অপরাধে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, কিন্তু একই অপরাধে অন্যদের মুক্তি দেওয়া হয় শুধুমাত্র তাদের সামাজিক অবস্থান বা প্রভাবের কারণে। এটি বিচার ব্যবস্থায় অন্যায্যতা নির্দেশ করে।
বৈষম্যমূলক চিকিৎসা সেবা: হাসপাতালে ধনী রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং দরিদ্র রোগীদের অপেক্ষা করানো হয় বা সঠিক সেবা দেওয়া হয় না। এটি অন্যায় ও অসম আচরণের একটি উদাহরণ।
পরীক্ষার ফলাফলে পক্ষপাতমূলক আচরণ: একজন শিক্ষক ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীকে বেশি নম্বর দেন, যদিও তার উত্তর অন্যদের তুলনায় দুর্বল ছিল। এটি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায্য আচরণ।
২। বিভেদ (Inequality): সমাজে বা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সমতার অভাব বা পার্থক্য। যেমনঃ
শিক্ষাক্ষেত্রে বিভেদ: গ্রামীণ অঞ্চলের স্কুলগুলিতে শিক্ষার মান শহরের স্কুলগুলির তুলনায় অনেক খারাপ। শহরের শিক্ষার্থীরা উন্নতমানের শিক্ষক, সুবিধা, এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, যেখানে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনী ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে পারে, যেখানে দরিদ্র ছাত্ররা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় উচ্চ টিউশন ফি-এর কারণে।
স্বাস্থ্যসেবায় বিভেদ: উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা শুধু ধনী ব্যক্তিরা পেতে পারে, যেখানে দরিদ্র মানুষরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা পান না বা সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। শহরের হাসপাতালগুলিতে উন্নত চিকিৎসা এবং আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে, কিন্তু গ্রামের হাসপাতালে প্রায়ই ডাক্তার, ঔষধ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের অভাব থাকে।
অর্থনৈতিক বিভেদ: ধনী এবং গরিবের মধ্যে আয় এবং সম্পদের বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। ধনী ব্যক্তিরা সমাজের প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, কিন্তু গরিবদের জন্য সেই সুবিধাগুলো প্রায় অপ্রাপ্য। কর্মসংস্থানে ধনী পরিবার থেকে আগত ব্যক্তিরা সহজেই ভালো চাকরি পেয়ে যায় তাদের সম্পর্ক ও সুযোগের কারণে, যেখানে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পেছনে পড়ে থাকে। যার কারনে ধনী, প্রভাবশালী আর ক্ষমতাবানদের দাম দিয়ে দেখা হয়।
কর্মসংস্থানে অসমতা: উচ্চবিত্ত এবং শহরের ব্যক্তিরা ভালো মানের চাকরির সুযোগ বেশি পায়, যেখানে গ্রামীণ বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের কাছে সেই সুযোগ সীমিত। কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লিঙ্গ, জাতি বা ধর্মের মানুষদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়, যার ফলে তারা ন্যায্য কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়।
৩। অনুভূত বৈষম্য (Perceived Inequality): ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনুভব করে যে তাদের প্রতি অন্যের তুলনায় ন্যায্য আচরণ করা হচ্ছে না। যেমনঃ
কর্মস্থলে কাজের চাপের বৈষম্য: একজন কর্মী মনে করতে পারেন যে তার সহকর্মীদের তুলনায় তাকে বেশি কাজ দেওয়া হচ্ছে। যদিও কর্মক্ষেত্রে কাজের বণ্টন হয়তো দক্ষতা বা পদ অনুযায়ী ঠিক আছে, তিনি মনে করেন যে তার ওপর অন্যায়ভাবে কাজের চাপ বেশি পড়ছে।
সরকারি সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য: কোনো সম্প্রদায় বা এলাকাবাসী মনে করতে পারেন যে সরকার তাদের জন্য যথেষ্ট উন্নয়ন বা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে না, যদিও সরকার সব এলাকায় সমানভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। তাদের ধারণা যে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
ক্রীড়াক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য: একজন খেলোয়াড় মনে করতে পারেন যে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অন্য একজন কম যোগ্য খেলোয়াড়কে সুযোগ দেওয়ার জন্য, যদিও কোচের সিদ্ধান্ত দক্ষতা, খেলার অবস্থা বা অন্যান্য যুক্তিযুক্ত কারণে নেওয়া হয়েছে।
৪। অসাম্যতা (Inequity): কোনো ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়ায় যে পার্থক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি হয়। যেমনঃ
স্বাস্থ্যসেবায় অসাম্য: উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার এবং গুণগত মানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উন্নত দেশে সাধারণত ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়, যখন উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দুর্বল এবং অনেক লোক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।
রাজনৈতিক অসাম্য (Political Inequity): নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগের ক্ষেত্রে অসাম্য। কিছু গোষ্ঠী বা জনগণের জন্য ভোটাধিকার বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার সুযোগ কম থাকলে, সেটি রাজনৈতিক অসাম্যের উদাহরণ হয়।
বৈষম্যের কারণ
রাজনৈতিক দুর্নীতি: রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সম্পদ ও সুযোগের বণ্টনে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থের একটি অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে গোপন করা হয়, তবে প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে না এবং জনগণের সুবিধা পাবে না।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অর্থনৈতিক সংকট এবং অস্থিতিশীলতার কারণে মানুষের জীবিকা ও সুযোগের অভাব হয়। শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, যেখানে শহরগুলোতে বেশি সম্পদ এবং সুযোগ থাকে, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় সাধারণত কম। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না, ফলে তারা দারিদ্র্যের শিকার হন।
শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা: শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত উন্নত মানের শিক্ষা দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার মান এবং সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। যেমন গ্রামে শিক্ষকদের অভাব এবং শিক্ষার পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে।
লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য: নারীদের প্রতি বৈষম্য এবং তাদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থতা একটি গুরুতর সমস্যা। নারীশিক্ষার অভাব এবং কর্মসংস্থানে সুযোগের অপ্রতুলতা নারীদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক করে তোলে। যেমন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হওয়ায় তারা ব্যবসায়িক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য: জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিভেদ ও বৈষম্য। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সমাজে বৈষম্যের শিকার হন, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধা দেয়।
স্বাস্থ্যসেবার অভাব: স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বৈষম্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা বেশি উন্নত, কিন্তু গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। যেমন, গ্রামের মানুষ যদি স্বাস্থ্যসেবা পেতে সমস্যা করে, তবে তারা চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে তাদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়।
সামাজিক সংস্কৃতি ও প্রথা: বাংলাদেশে কিছু সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতি বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। যেমন, পুরনো সামাজিক ধারণা অনুযায়ী, নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব কম বিবেচনা করা হয়, যা তাদের সামাজিক অবস্থানকে দুর্বল করে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক নীতি এবং গুণগত সেবার অভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেখানে গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে, তাদের চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে হয়।
কারা বৈষম্যের শিকার
নারী: পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক নারী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিম্ন মজুরির ও অস্থায়ী কাজের ওপর নির্ভরশীল থাকে। নারীরা গৃহকর্ম ও সন্তান পালনকে কেন্দ্র করে অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারেন না। নারীরা প্রায়ই গৃহস্থলীতে, কাজের স্থলে এবং সমাজে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা তাদের নিরাপত্তা এবং আত্মসম্মানকে ক্ষুণ্ণ করে। নারীদের অনেক সময় যৌন নিপীড়ন ও অবমাননার শিকার হতে হয়, যা তাদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য এবং সমাজে অবস্থানকে প্রভাবিত করে।
শিক্ষাহীন বা কম শিক্ষিত মানুষ: কম শিক্ষিত ব্যক্তিরা সাধারণত উচ্চ দক্ষতার চাকরি পেতে পারেন না, ফলে তাদের জন্য কাজের সুযোগ সীমিত থাকে। শিক্ষার অভাবে তারা সাধারণত কম আয় করেন, যা তাদের জীবনযাত্রা ও পরিবারের সচ্ছলতাকে প্রভাবিত করে। শিক্ষাহীন ব্যক্তিদের প্রতি সমাজে একটি নেতিবাচক মনোভাব থাকতে পারে, যা তাদের সম্মান এবং সামাজিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করে। শিক্ষাহীন বা কম শিক্ষিত মানুষ শহরের উন্নত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক সময় অবহেলিত হয়।
গ্রামাঞ্চলের লোকজন: গ্রামীণ জনগণের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্প আয়ের কৃষক বা শ্রমিক। তারা প্রায়ই সঠিক মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব এবং সঠিক শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা হয়। গ্রামের মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি প্রকল্প ও সহায়তা অনেক সময় তাদের কাছে পৌঁছায় না, বা তা অসমভাবে বিতরণ হয়। গ্রামীণ জনগণ শহরের উন্নত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অবহেলিত থাকে, যেমন পর্যাপ্ত অবকাঠামো, বাজার, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে তারা ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।
স্বল্প আয়ের জনগণ: স্বল্প আয়ের জনগণ প্রায়ই কাজের সুযোগ এবং উন্নত জীবিকার জন্য সমান সুযোগ পায় না। উচ্চ বেতন ও সুবিধাসম্পন্ন চাকরিতে প্রবেশের পথে তাদের বাধা থাকে। অনেক স্বল্প আয়ের পরিবার তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে পারে না। স্বল্প আয়ের জনগণ প্রায়ই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। স্বল্প আয়ের জনগণ শহরের বস্তি বা দুর্গম এলাকায় বাস করে, যেখানে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো নেই। স্বল্প আয়ের জনগণের বিরুদ্ধে সমাজে একটি নেতিবাচক মনোভাব থাকে, যা তাদের সামাজিক অবস্থান এবং সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করে।
নির্দিষ্ট দল এবং গোষ্ঠী: কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্বের অভাবে বা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে, ফলে তাদের নিজস্ব স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হয় না। দেশের আইন ও নীতিমালা এমন হয় যা বিশেষ গোষ্ঠীকে নিপীড়ন করে এবং তাদের অধিকারের লঙ্ঘন করে।
কর্মী/কর্মচারী: যদি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা বা নিয়মাবলী পক্ষপাতদুষ্ট হয়, কর্মী তাদের যোগ্যতা বা দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি বা নতুন কাজের সুযোগ পেতে ব্যর্থ হন। একে অপরের তুলনায় বিভিন্ন কর্মীদের জন্য বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য হয়। কর্মক্ষেত্রে কিছু কর্মী হয়রানি, বৈষম্যমূলক মন্তব্য বা আচরণের শিকার হন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং কাজের পরিবেশকে ক্ষুণ্ণ করে। কিছু ক্ষেত্রে, অফিসারদের মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাবের কারণে নির্দিষ্ট কর্মীদের স্বার্থ এবং সমস্যাগুলি প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হন।
যে কারণে বৈষম্য সৃষ্টি হয়
রাজনৈতিক কারণ: দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অকার্যকর নীতির মাধ্যমে নেতারা বৈষম্য বৃদ্ধি করেন। রাজনৈতিক দল বা নেতৃবৃন্দ অনেক সময় ক্ষমতা, সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধার বণ্টনে বৈষম্য সৃষ্টি করে। ক্ষমতাসীন দল বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের অনুগতদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে, যা বৈষম্যকে আরও তীব্র করে। অনেক সময় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে রাজনৈতিক অনুগত অঞ্চলে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়, অন্য অঞ্চলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয় না। এর ফলে এলাকার জনগণের জীবনমান উন্নত হয় না এবং তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক নীতি এবং গুণগত সেবার অভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেখানে গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে, তাদের চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে হয়।
সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বৈষম্য: সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও বৈষম্য দেখা যায়, যা চাকরি, পদোন্নতি এবং সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সরকারী চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক সুপারিশ প্রয়োজন হয়, যা সাধারণ জনগণের জন্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত করে।
বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওতে বৈষম্য: অনেক সময় বিভিন্ন এনজিও বা বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার সময় অগ্রাধিকার দেওয়া অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীকে বেশি গুরুত্ব দেয়, এবং কম প্রভাবশালী অঞ্চলের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
অর্থনৈতিক শ্রেণি: ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা তাদের আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেক সময় সুবিধা আদায় করেন, যা গরীবদের জন্য বৈষম্যের কারণ হয়। ধনী শ্রেণির অনুকূলে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে গরিব জনগণ পিছিয়ে পড়ে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রকল্পগুলো শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের মানুষ পিছিয়ে যায়।
লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি করা গোষ্ঠী: সমাজের কিছু অংশ নারীকে অবমূল্যায়ন করে এবং তাদের কাজের সুযোগ সীমিত করে। নারীরা কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সামাজিক স্থানে পুরুষদের তুলনায় বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হন।
নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী প্রায়শই জমি অধিকার, উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের সাথে ভূমি অধিকার, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য: কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে চাকরি, ব্যবসা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষ প্রায়শই তাদের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন।
বৈষম্য দূর করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে
শিক্ষার উন্নতি: সমন্বিত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে গ্রামের শিশুদের জন্য। সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে নারীদের এবং প্রান্তিক জনগণের জন্য। সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো, যাতে মানুষ বৈষম্যের বিষয়টি বুঝতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
অর্থনৈতিক সুযোগ: অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, যাতে গরিব জনগণ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। স্বনির্ভরতা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করা। দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর নীতি গ্রহণ করা, যাতে সকলের জন্য উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
লিঙ্গ সমতা: নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায়। নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ বৃদ্ধি করা। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনি সহায়তা প্রদান করা।
সচেতনতা বৃদ্ধি: সামাজিক বৈষম্য নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বৈষম্য প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করা।
নীতিগত পরিবর্তন: সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে বৈষম্য নির্মূলের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার: বৈষম্য নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় আইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। রাজনৈতিক দুর্নীতি দূরীকরণের জন্য কঠোর আইন ও দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা।
সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা: সামাজিক নিরাপত্তা নেটের মাধ্যমে দুর্বল জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা।
বৈষম্য দূর করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী গোষ্ঠী
সরকার: সরকারের নীতি এবং আইনগত কাঠামো বৈষম্য দূর করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
নাগরিক সমাজ: এনজিও ও সামাজিক সংগঠনগুলি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
মিডিয়া: মিডিয়া বৈষম্যের সমস্যা তুলে ধরতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিক উদ্যোক্তারা: সামাজিক উদ্যোক্তারা নতুন ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে এবং সমাজের দুর্বল গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
কমিউনিটি লিডারস: স্থানীয় নেতা এবং সমাজকর্মীরা জনগণের মধ্যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
বৈষম্য দূর করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গুনাবলী
নৈতিকতা ও সততা: ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে কাজ করার অঙ্গীকার থাকা। তারা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নৈতিক ও ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে।
সহানুভূতি: ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা ও দুঃখ বোঝার এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করার ক্ষমতা। এই গুণ তাদেরকে কার্যকরভাবে সহায়তা করতে সাহায্য করবে।
নেতৃত্বের ক্ষমতা: দলকে সঠিক দিশা দেখাতে এবং সমন্বয় সাধনে সক্ষম হওয়া। একজন নেতার মধ্যে জনগণের মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকা জরুরি।
সামাজিক সচেতনতা: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান এবং বৈষম্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া।
নিরপেক্ষতা: পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে চলা এবং সকল মানুষের প্রতি সমান আচরণ করা। এটা তাদের কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
প্রভাব বিস্তার: সমষ্টিগত পরিবর্তনের জন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকা। তারা যেন সমাজের উন্নতির জন্য মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করতে পারে।
সমস্যা সমাধানের দক্ষতা: বৈষম্য এবং সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য সৃজনশীল এবং কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার ক্ষমতা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
ভোরের আকাশ/রন