logo
আপডেট : ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:০৫
বিএনপির বাধায় অন্যরা দ্বিধায়
এম সাইফুল ইসলাম

বিএনপির বাধায় অন্যরা দ্বিধায়

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে—এমন যুক্তিতে তার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং কয়েকটি দলের আহ্বানের পরও বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করছে না। কিছু দল বিএনপির সঙ্গে সুরও মেলাচ্ছে। এতে দ্বিধায় পড়েছে কয়েকটি দল। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অনেক দল রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে ছাত্রদের দৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এই দলগুলো হলো—জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া পেছানোসহ নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেজন্য তারা এখন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ চান না। বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে দলটির মিত্র ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্রও বলেছেন, বিএনপির অবস্থানের বাইরে তারা যেতে চান না। প্রয়োজনে আগে জাতীয় সরকার গঠন করে তারপর রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় গণঅধিকার পরিষদ। আর জামায়াত, অলি আহমদের এলডিপি, এবি পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, কোনো অজুহাতে মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে একদিনও দেখতে চান না তারা।

‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র হাতে পাননি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন’—সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকায় এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদ প্রকাশের পর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ আনেন। রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। প্রথমে শহীদ মিনারে, পরে বঙ্গভবনের সামনেও সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেন, যা নিয়ে বঙ্গভবনের সামনে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় জনসাধারণের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

প্রথম দিকে বিএনপি নেতারাও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পক্ষে কথা বলেন। দলটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও গত ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেন। একদিন পরে তিনি ভিন্ন বক্তব্য দেন। ২৩ অক্টোবর নজরুল ইসলাম খানসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে বের হয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন—দেশে যাতে নতুন করে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য খেয়াল রাখতে বলেছি। আমরা কোনো সাংবিধানিক সংকট চাই না। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যদি কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকামীরা তা প্রতিহত করব। একই দিনে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আরেক ব্রিফিংয়ে বলেন, রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টি করবে। সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে, যেটা জাতির কাম্য নয়। এই সংকটের কারণে যদি জাতির গণতন্ত্রে উত্তরণ বিলম্বিত হয় বা বাধাগ্রস্ত হয়, সেটাও জাতির কাম্য নয়। অর্থাৎ, বিষয়টি নিয়ে দলটির ইউটার্ন নেয়।

বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকে নীরব থাকলেও গত ২৬ অক্টোবর শেষ পর্যন্ত মুখ খোলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ চেয়ে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। তিনি বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ চায়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একই কথা বলে আসছে।

জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। শনিবার তারা বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নিয়ে দলটির অবস্থান ছাত্র নেতাদেরকে জানানো হবে বলে বিএনপি জানিয়েছে। ওই বৈঠকের পরও প্রতিদিন বিএনপি নেতারা সভা সমাবেশে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিপক্ষে কথা বলছেন। রাষ্ট্রপতির পদে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন পেছানোসহ নানা আশঙ্কা করছে দলটি। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে বিরুদ্ধে বিএনপি সরাসরি অবস্থান নেয়ায় দলটির সঙ্গে ইতঃপূর্বে আন্দোলনে থাকা অনেক দল এখন দ্বিধায় পড়েছে। তারা কী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চাইবে, নাকি বৃহৎ দল বিএনপির অবস্থানে সুর মেলাবে।

এদিকে, গত কয়েকদিনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ১২-দলীয় জোট, এবি পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এর মধ্যে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সরাসরি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে কথা বলেছেন। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। অবশ্য জোটটির প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে নীতিগতভাবে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে একমতে পৌঁছেছেন।

এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, একটা রাষ্ট্রে বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে অনেক ধরনের ঝামেলা থাকে, অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া যায় না। সে সময় যে একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, নানা কারণে তখন তা নেওয়া যায়নি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নিজেই নিজের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। সেই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন। মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতির পদে থাকার কোনো যৌক্তিকতা ও বৈধতা নেই। এ রাষ্ট্রপতিকে যদি আমরা বিদায় না করি বা তিনি যদি পদত্যাগ না করেন, এটা আমাদের জাতীয় জীবনের মহাসংকট হিসেবে থাকবে। আর তিনি বিদায় নিলে যে শূন্যতার কথা বলা হচ্ছে, সেটি নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটা রেফারেন্স চাওয়া যেতে পারে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে সমস্যা তা কিন্তু নয়। এসব সমস্যা সমাধানের আগে প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ও অংশীজনদের নিয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা প্রয়োজন। তারপর রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করতে হবে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী মনে করে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন সেটি নিরসনের দায়িত্ব তার নিজের। এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার কারণে তিনি এই মহান দায়িত্বে থাকার নৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়েছেন। এখন এই পদে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব থেকে চলে গেলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে না বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী।

এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, যদি রাষ্ট্রপতি মারা যান তাহলে কী হবে? একটা কিছু তো হবে। অনেক কিছুই তো সংবিধানে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সংবিধানে নেই, তাহলে গঠিত হলো কীভাবে? তিনি বলেন, এই রাষ্ট্রপতিকে এক মিনিটও রাখার পক্ষে নন তিনি।

এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ বা তাকে অপসারণ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা ও রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হলে তৃতীয় পক্ষ বা পক্ষ দূরভিসন্ধি কাজ করবে কিনা, সেই গ্যারান্টি কে দেবে? রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকটের মুখোমুখি আমরা হতে চাই না। আমরা চাই গণতন্ত্র উত্তরণের পথে অন্য কোনো কিছু যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

 

ভোরের আকাশ/রন