- ৪০ কোটি কপি বইয়ের সময়মতো মুদ্রণ শেষ হওয়া নিয়ে সন্দেহ
- ২০১০ সাল থেকে সরকার শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনেই পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে আসছে
- এনসিটিবি কর্মকর্তাদের মতে, এই দেরির বড় কারণ হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
প্রতি বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয় সরকার। সেই ধারায় ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারিতে আসন্ন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণের জন্য বই ছাপাতে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে সরকারকে।
শনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা ও মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, গত শনিবার থেকে মুদ্রণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে, সব ক্লাসের বইয়ের সংশোধন এখনো শেষ হয়নি। এর আগের বছরগুলোতে সাধারণত বছরের এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপা হয়ে যেতো। মুদ্রণ কাজ দেরিতে শুরু হওয়ায় বছরের শেষ নাগাদ চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ কোটি কপি বইয়ের সময়মত মুদ্রণ শেষ হওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে সরকার প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে আসছে। এনসিটিবি কর্মকর্তাদের মতে, এই দেরির বড় কারণ হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তবে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, মুদ্রণ খাত ও অন্যান্য অংশীজনদের পূর্ণ সহযোগিতায় এখনও সময়মতো পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ সম্ভব হতে পারে।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী বলেন, আমরা পাঠ্যপুস্তক সংশোধন প্রায় শেষ করেছি। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাণ্ডুলিপি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। বাকিগুলোও শিগগির পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সময় মতো বই বিতরণ সম্পর্কে তৈরি সন্দেহ সম্পর্কে তিনি বলেন, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় এই চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়েছে। তবে সময়মতো বই বিতরণ নিশ্চিত করতে আমরা সবার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত তিন বছরেও যথাসময়ে বই বিতরণ করা চ্যালেঞ্জ ছিল। ২০২২, ২০২৩ ও চলতি শিক্ষাবর্ষের অষ্টম ও নবম শ্রেণির তিন কোটিরও বেশি বই যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের সব বইয়ের জন্য মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে ২০২১ সালে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ প্রক্রিয়ায় দেরি হয়েছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ২০২২ সালে চালু করা পাঠ্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে যে বই যাবে, সেখানে ‘অতিরিক্ত’ ঐতিহাসিক তথ্য বা কোনো ব্যক্তির ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রশংসা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চলতি শিক্ষাবর্ষের জন্য গত বছর প্রায় ৩১ কোটি পাঠ্যবই ছেপেছে সরকার। তবে, পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কারণে ২০২৫ সালের জন্য বই ছাপতে হবে ৪০ কোটি। প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এ বছরের শেষ নাগাদ সব ছেপে শেষ করা ‘কার্যত অসম্ভব’। তারা দ্রুত পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করতে এবং মুদ্রণ প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে দরপত্রের শর্ত শিথিল করার জন্য এনসিটিবিকে অনুরোধ জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, সময়মতো পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নিশ্চিত করার জন্য এনসিটিবির একটি কাঠামোগত পরিকল্পনা থাকা উচিত। কিন্তু তারা সম্ভবত সেটা করতে পারেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বছরের প্রথম দিনেই সব বই দেওয়া সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এনসিটিবি এখনও পুরানো পাঠ্যক্রমের বইগুলো সংশোধন করছে। এখনও অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র দেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, এবার এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তকের জন্য উচ্চমানের কাগজ ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই দাবি ছিল সবারই। একই সময়ে সব বই ছাপার কার্যাদেশ দেওয়া হলে এই কাগজের সরবরাহেও ঘাটতি পড়তে পারে। কারণ, গাইড বই প্রকাশকরাও সাধারণত একই সময়ের মধ্যে ছাপার কাজ করে থাকেন। তার ভাষ্য, এনসিটিবির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। শীর্ষ পদগুলোতে নতুন দায়িত্ব যারা নিয়েছেন, তারা নিজেদের কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল হলেও অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। আর নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা যথাযথভাবে সহযোগিতা করছে না। সমন্বয় ছাড়া এভাবে চললে এনসিটিবি আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে বলেন, হ্যা, আমাদের সংস্থায় নতুন পদায়ন হওয়ায় কিছু সমস্যা আছে। তবে আমরা এই বছরের মধ্যে সব বই ছাপার কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, ছোট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কিছু শর্ত শিথিল করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তাদেরও বই ছাপার কাজে সম্পৃক্ত করা হবে, যাতে কাজে গতি আসে।
ভোরের আকাশ/রন