logo
আপডেট : ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:০৫
আলোচনা থেকে দূরে মূল এজেন্ডা!
নিখিল মানখিন

আলোচনা থেকে দূরে মূল এজেন্ডা!

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রার তিন মাস পূর্ণ হবে আগামী ৮ নভেম্বর। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিনিয়ত সরকারকে নতুন নতুন নানা ইস্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এক ইস্যুর সমাধান না হতেই সামনে চলে আসছে আরেকটি। কখনও সরকারের উপদেষ্টা, আবার কখনও রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা কখনও সরকার পতনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নানা পদক্ষেপ, বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে থাকেন সবাই। এখন চলছে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক। এমন সব ইস্যুর ভিড়ে আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে প্রধান ইস্যু নির্বাচন। অথচ এই সরকারের প্রধান এজেন্ডা থাকার কথা ছিল দেশকে দ্রুততম গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে নিতে একটি স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজনের ব্যবস্থা করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক জটিলতা এবং সংস্কার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতায় নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার যৌক্তিক সময়ও দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ও অপসারণ ইস্যু এক্ষেত্রে নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রত্যাশিত গতিতে এগোতে পারছে না সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি জোরালো হলে তাদের নিয়ে বসেন সংলাপে। পরক্ষণেই ঘটে যায় নতুন রাজনৈতিক সংকট। নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিও চলে যায় আলোচনার বাইরে। এর মধ্যে সেনাপ্রধানের বক্তব্যে ‘দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন’ তথ্যটি বেরিয়ে এলেও রোডম্যাপ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। সরকারের মেয়াদ কতদিন তা সরকারই জানাবে বলে ইতোমধ্যে মন্তব্য করে রেখেছেন উপদেষ্টা প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনের সময়ের বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রায় সমার্থক মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কবে দেবে — এই প্রশ্ন ইস্যুতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি সরকারের নয় বলে মন্তব্য করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।

নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার ভিত্তিতে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসউইং থেকে জানানো হয়। কিন্তু সংস্কার কমিশনগুলোর মূল কাজ শুরু হতে এখনো অনেক দূর পথ। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। মূলত এরপরই সংস্কারের মূল কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। তারপর সংস্কার করতে ঠিক কত সময় লাগবে এবং কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার।

এরপর নানা সমালোচনার মুখে নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসেন আসিফ নজরুল। তবে গতকাল নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়েছে, কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপন শিগগিরই প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছেন আসিফ নজরুল।

সংস্কার কমিশনসমূহের কাজের অগ্রগতি
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তবে পরে আরও যে চারটি কমিশনের প্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে ওই চারটি কমিশনের গেজেট এখনো প্রকাশ হয়নি। গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর তাদের কাজ শুরু হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, আগে যে ছয়টি কমিশন হয়েছে, তারা গেজেট প্রকাশের পরই কাজ শুরু করেছে। আর বাকি চারটি কমিশনের প্রধানদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিশনের গেজেট কয়েক দিনের মধ্যেই হবে।

গত ৩ অক্টোবর পাঁচটি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেগুলো হলো, বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। ১৭ অক্টোবর আরও চারটি কমিশন করার কথা ও প্রধানদের নাম জানান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেগুলো হলো- স্বাস্থ্য কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান, গণমাধ্যম কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, নারীবিষয়ক কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক এবং শ্রমিক অধিকার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ।

নারীবিষয়ক কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক সাংবাদিকদের বলেন, আমি এখানো বিস্তারিত কিছু জানি না। কমিশনের অন্য সদস্য কারা হবেন তাও জানি না। আমাকে টার্মস অব রেফারেন্সসহ বিস্তারিত জানালে কাজ শুরু করতে পারবো। তার আগে কিছু করতে পারছি না।

এই চারটি কমিশনও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করবে। প্রত্যেকটি কমিশনের মেয়াদ গেজেট প্রকাশের দিন থেকে ছয় মাস। কমিশন প্রধান এবং এর সদস্যরা পূর্ণকালীন হিসেবে কমিশনে কাজ করছেন। এই সময়ে তারা অন্য কাজ থেকে বিরত থাকবেন। তাদের কাজের জন্য অফিস এবং সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তারা প্রতিবেদন দেবেন প্রধান উপদেষ্টাকে।

গেজেট হওয়া ছয়টি কমিশনের সদস্যদের সঙ্গেই কথা বললে তারা স্পষ্ট করেন যে, প্রতিটি কমিশনই তাদের নিজেদের মধ্যে বৈঠক এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। তারা তাদের কাজের জন্য কমিশনের সদস্যদের বাইরের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নিচ্ছেন। এর বাইরে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করবেন। কয়েকটি কমিশন ওয়েব সাইটও চালু করছে। ওই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে তারা দেশের সাধারণ মানুষকেও মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দেবেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নির্বাচন কমিশনে বসেই তাদের কাজ করছে। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, আমরা তো ফুলটাইম কাজ করছি। প্রতিদিনই আমাদের বৈঠক হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করছি। প্রচলিত আইন বিধি দেখছি। আমাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। আমরা নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা প্রাথমিক সুপারিশ তৈরি করে তারপর আরো কাজ করবো। তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের সুপারিশ পেশ করবো। এটা শুধু নির্বাচন কমিশন সংস্কার নয়। আমাদের কাজ হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের সুপারিশ করা।

অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, অনেকে মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আসলে পুরো কাজ করতে হলে সংবিধান, আইনের পরিবর্তন করতে হবে। আমরা এই সব কিছু নিয়েই কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা।

তিনি জানান, তারা এ নিয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গেও মতবিনিময় করবেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন। আর একটি ওয়েবসাইট খুলছেন, যেখানে দেশের মানুষ তাদের মতামত দিতে পারবেন। সেগুলোও তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশা করছি, একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী তৈরি করার জন্য আমরা ভালো একটি সুপারিশ করতে পারবো। কমিশনে যারা আছেন, তারা সবাই অভিজ্ঞ। তারা পুলিশ নিয়ে অতীতে অনেক কাজ করেছেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিচ্ছেন। আমরা এরই মধ্যে অনেকগুলো বৈঠক করেছি। আমরা বাইরে থেকেও যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের মতামত নিচ্ছি। মতবিনিময় করবো। সাধারণ মানুষের মতামতও নেব। এটা একটা বিশাল কাজ। চেষ্টা করছি নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে। সে জন্য একটা প্রাথমিক ড্রাফট করে তার ওপর আবার আমরা আলোচনা করবো, তথ্য নেব, মতামত নেব, তারপর চূড়ান্ত করবো। আমাদের টার্গেট হলো পুলিশকে জনগণের পুলিশ করার মতো একটা সুপারিশ করা।

আর জন প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম ফিরোজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত একটি বৈঠক করেছি। ফলে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা আরো কয়েকটি বৈঠক করলে বুঝতে পারবো আমরা কোন জায়গায় আছি, কোন দিকে যাব।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও এরই মধ্যে বেশ কয়েটি বৈঠক করেছে বলে জানান কমিশন সদস্য, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী মাজদার হোসেন। তিনি জানান, আমরা প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছি। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। তবে এখন বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না। তবে আমরা ভালো কিছু একটা করতে চাই।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শরীফ ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মিটিং ১৩ ও ২১ অক্টোবর হয়েছে। এর বাইরে এখন আর কিছু বলা যাবে না। আমাদের কাজের অগ্রগতি পরে প্রেস ব্রিফিং করে জানাব।

আর দুর্নীতি সংস্কার কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোমেন কমিশনের কাজ শুরু হওয়ার কথা জানালেও বিস্তারিত কিছু বলেননি।

গত ১৮ অক্টোবার বিকেলে কক্সবাজার সফর শেষে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, আমরা ভোটিং কালচার নিশ্চিত করতে চাই। এখন রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, রাজনৈতিক দলগুলোর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ভোটার হালনাগাদ কাজ করবে সরকার। তার পরই আমরা নির্বাচন দেব, যাতে দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। নাজুক একটি পরিস্থিতিতে সরকার কাজ শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। দেশের ভোটিং কালচার নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমরা ভোটিং কালচার নিশ্চিত করতে চাই। এখন রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, রাজনৈতিক দলগুলোর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ভোটার হালনাগাদ কাজ করবে সরকার। তার পর নির্বাচন, যাতে দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

রাষ্ট্রপতি নিয়ে সংকট
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদে থাকা এবং না থাকা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের ওপর একদিকে সাংবিধানিক সংকট দূরীকরণ, অন্যদিকে সংস্কার কমিশনগুলোর কাজের গতিবিধি এবং লক্ষ্যসমূহ অর্জনও অনেকাংশে নির্ভর করছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতির দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর রাষ্ট্রপ্রধানকে সরানোর উদ্যোগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা অপসারণের ক্ষেত্রে কিছু সাংবিধানিক জটিলতা সামনে এসেছে। আচমকা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিরোধিতা করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে এতে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি তুলে আন্দোলন শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া ছাত্রদের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম পার হয়েছে দুদিন আগে। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়টি উঠেছে এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন স্পিকারের নিকট। আর তাকে অপসারণ করতে পারে নির্বাচিত সংসদ। এখন সংসদ বিলুপ্ত আবার স্পিকারও পদত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দেশে রাজনৈতিক সংকট এবং সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি পদটি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। গণঅভ্যুত্থান এবং পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপতির থাকা না থাকার বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখছে।

সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির থাকবে কি থাকবে না এটি আইনি কিংবা সাংবিধানিক বিষয় নয় এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে এর সমাধান হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকার সবচে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন) বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা পদত্যাগের কোনো সাংবিধানিক পথ খোলা নেই। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। এদিকে সংবিধানও স্থগিত করা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের সুযোগ না থাকায়, রাষ্ট্রপতিকে এখন অপসারণ করা হলে, সেটি সংবিধানের বাইরে গিয়ে করতে হবে, যেটি একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে।’

রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ করলে কিছু জটিলতার দিক উল্লেখ করে শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, মনে রাখতে হবে, ৫ আগস্টের পরে এই রাষ্ট্রপতি এই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ করিয়েছেন এবং তিনি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদি ৫ আগস্টের পরে আগের সরকারের সংসদ, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার সকলকে বাদ দিয়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটির বরাত দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে সরকার গঠিত হতো, তাহলে আজ এ প্রশ্ন উঠত না।”

বিএনপি ও জামায়াতের মতবিরোধ
রাষ্ট্রপটতি ইস্যু নিয়ে গত বুধবার বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই পদটা একটা সাংবিধানিক পদ, একটা প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সংকটের সৃষ্টি হবে।’

আর গতকাল শনিবার দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক আব্দুল হালিম বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ চায় জামায়াতে ইসলামী। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব মৌলিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেবে।’

রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে এত ব্যস্ত কেন, প্রশ্ন রিজভীর
দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করলে জনগণ কথা বলা শুরু করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে তিনি,‘আপনারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছেন সেখানেই অনেকের বিচার হবে। কিন্তু আমরা যদি কাজের বদলে অ-কাজে বেশি লিপ্ত হয়ে পড়ি রাজনৈতিক শূন্যতা, সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করি, তাহলে তো জনগণ কথা বলা শুরু করবে। শুধু জটিলতার পর জটিলতা তৈরি করছেন কেন আপনারা? শেখ হাসিনার দোসর তো আরও অনেকেই আছে আপনাদের মধ্যে কই তাদের বিষয়ে তো আপনারা কিছু বলছেন না। শুধু রাষ্ট্রপতিকে নিয়েই আপনারা এত ব্যস্ত আছেন কেন।’

গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর আজিমপুর এতিমখানা সড়ক, গোর এ শহীদ মাজার এতিমখানার সামনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসাবিষয়ক লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

রিজভী আরও বলেন,‘আলী ইমাম মজুমদার যিনি ১/১১ তেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিলেন, শেখ হাসিনার আমলেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তাকে আপনারা উপদেষ্টা বানিয়েছেন, এইরকম তো অনেকেই রয়েছেন এসব বিষয়ে আপনারা তো কিছু বলেন না। শেখ হাসিনার রক্তাক্ত দুঃশাসনকে যারা প্রলম্বিত করেছে, টু শব্দ যারা করেনি যারা নিঃস্বার্থভাবে শেখ হাসিনার তাঁবেদারি করেছে তারা তো এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন,‘আজকে রাষ্ট্রপতি থাকলেন কি থাকলেন না এইটা নিয়ে আমরা দেশে কেন জটিলতা তৈরি করছি? কেন আমরা দেশে সঙ্কট ডেকে নিয়ে আসব। এটা মুখ্য বিষয় নয়। আমরা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছি তার দোসরদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার করা হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব।’

রিজভী বলেন, ‘গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের অবদান এ দেশের মানুষ ইতিহাসে লিখবে। একটা সোনালি অধ্যায় রচিত হবে। কিন্তু আবেগের বশবর্তী হয়ে আমাদের এমন কিছু করা যাবে না যাতে এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল সংবিধান বহির্ভূত কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

 

ভোরের আকাশ/রন