রুম নং ২১২, মাস্টার দা সূর্যসেন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই রুমে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আমার বসবাস শুরু হয়েছিল। ২০১১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ওই রুমবাসের ইতি ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষে চাকরিতে যোগদানের সৌভাগ্য অর্জন করা দুই একজন সহপাঠীর মধ্যে আমি অন্যতম ছিলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষে ফলাফল প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সৌভাগ্য হলেও ওই রুমে বসবাসের স্মৃতি আনন্দময় ছিল না।
আমার রুমের পাশের রুমে ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বসবাস করতেন। সারারাত মদ খেয়ে উচ্চৈঃস্বরে চেঁচামেচি করে আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে তাস খেলে তিনি আমার পড়াশোনা লাটে তোলার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করার লড়াইয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করা এই আমি তাই বাধ্য হয়েই হাউস টিউটরকে উক্ত ছাত্রলীগ নেতার বিরক্তিকর আচরণ জানাতে বাধ্য হই। তিনি আশ্বস্ত করলেন বিষয়টি দেখবেন বলে। কয়েকদিন পর হল ছাত্রলীগের এক নেতা আমার সঙ্গে কথা বললেন এবং নিশ্চিত করলেন যে, আমার প্রতিবেশী রুমমেট তার অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করবেন যাতে আমার পড়াশোনার ব্যাঘাত না ঘটে।
প্রতিবেশী রুমমেট তার বিরক্তিকর কার্যক্রম বন্ধ করলেও তিনি আজও আমাকে আড় চোখে দেখেন। উপরোক্ত ঘটনা থেকে দুইটি বিষয় পরিষ্কার হয়, প্রথমত, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের যেমনÑ জায়গা ছিল তেমনি অনেক ভালো ছাত্রনেতাও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, ছাত্রলীগের নেতারা ছিলেন হলের হর্তাকর্তা। তাদের কারণে হলে হাউস টিউটর ও সাধারণ ছাত্ররা অসহায় ছিল। আমার হলের হাউস টিউটরও ওই দুর্বৃত্ত ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। বরং আমার জন্য উপর্যুক্ত পড়ার পরিবেশ তৈরি করার জন্য তাকে অন্য ছাত্রলীগ নেতার সাহায্য নিতে হয়েছে। ওই ঘটনা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ক্ষমতার কাছে আইনের হাত-পা বাঁধা ছিল।
তাই একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগ সম্পর্কে আমার ধারণা মিশ্র। আমি ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মীর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম যেমন প্রত্যক্ষ করেছি তেমনি দেশের কল্যাণে ছাত্রদের কল্যাণে নিবেদিন প্রাণ অনেক ভালো ছাত্রলীগ নেতাকে দেখেছি। তবে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী নেতাদের কারণে তারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়তো বহুবার এমনটি দেখেছি। ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মীর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম কেবল ছাত্রলীগের সমস্যা নয়, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির মৌলিক সমস্যা। জুলাই বিপ্লবের পরও চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ না হওয়ার ঘটনা তার বড় প্রমাণ। তাই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার চেয়ে ছাত্ররাজনীতির সংস্কার করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছাত্ররা যেন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়াতে না পারে সেই পথ তৈরি করা দরকার। কিন্তু হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই ‘ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে’র মতো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গেজেট জারি করে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করলো কেন সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি।
আমার কাছে মনে হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশ বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। সরকারকে পুরোপুরি আওয়ামী লীগ মুক্ত করে তারা বিপ্লবোত্তর ভুল সংশোধন করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের ওই উদ্যোগ বিপ্লবের দেশি ও বিদেশি স্টেক হোল্ডারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে তারা সাধারণ মানুষের মনোযোগকে ভিন্নখাতে নিতে হঠাৎ ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা যে আইনের ধারায় ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করেছে তা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা বেশ হাস্যকর ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ ব্যবহার করা হয়েছে। আল-কায়েদা বা আইএস নিষিদ্ধ করা আর ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা এক বিষয় নয়। প্রধানত আল-কায়েদা বা আইএসয়ের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন করা হয়। ওই সব সংগঠন সাংগঠনিকভাবে জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে বিধায় তাদের ক্ষেত্রে ওই আইন প্রয়োগ যতটা সহজ ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে একইভাবে ওই আইন প্রয়োগ করা ততটা কঠিন। কারণ জনগণের কাছে শেষ বিচারে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
জনগণকে সব সরকারই বোকা মনে করেছে এবং তারা ভেবেছে তারা সরকারের তরফ থেকে যে ন্যারেটিভ প্রচার করবে তাই জনগণ বিশ্বাস করবে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের নিজস্ব একটি বিচার-বিবেচনাবোধ আছে। শাসকের উচিত জনগণের ওই দৃষ্টিভঙ্গিকে উপলব্ধি করা। বিগত সরকারগুলো ওই বিবেচনাবোধ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই সরকার থেকে তারা হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সরকারও একই পথে হাঁটলে তাদের শেষ গন্তব্যও একই পথে হবে।
এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা যাক। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রবাসে সিট-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নসহ নানা জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।’ ওই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, ‘গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশ্রস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।’
এর পরের অংশে প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছে তা অনেকটা ট্র্যাডিশনাল কথা। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে ট্যাগিং রাজনীতির মতো রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের বাহানা আমরা বিগত সরকারগুলোর সময়েও দেখেছি।
প্রজ্ঞাপনের শেষাংশ অনেকটা বিগত সময়ের প্রচলিত কথাবার্তা বিধায় ওই অংশ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। যদিও আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিগত সময়ের মতো ট্র্যাডিশনাল কাজ আশা করি না। জুলাই বিপ্লবের চেতনাও ওই ট্র্যাডিশনাল কাজ ও কথাকে সমর্থন করে না। বরং সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো তারা এমন কিছু করবে যা স্থায়ী হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সুদূরপ্রসারী কাজে লাগবে। এক কথায় যাকে বলে ‘খোল নালচে বদলে দেওয়া’। যদি সত্যিকারভাবে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতির খোলনালচে বদলে ফেলা যায় তাহলে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই খোল নালচে বদলানোর বদলে নিষিদ্ধের খেলায় মেতেছে যা শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ানো বৈ রাষ্ট্র ও জনগণের কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। বরং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মবতন্ত্রের অবসানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাস্তবায়ন করা তাদের কাঁধে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট ও মবতন্ত্রের যাঁতাকলে জীবন ওষ্ঠাগত হওয়া জনগণের ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হলো না ছাত্রলীগকে সিদ্ধ করা হলো তাতে স্বস্তি খোঁজার কোনো কারণ নেই। বরং ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সংঘাত বাড়লে তারা বর্তমান সরকারের প্রতি আরও বিরক্ত হবে। এবার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনে দাবিগুলোর কতিপয় বিষয় আলোকপাত করা যাক। প্রজ্ঞাপনের প্রথম অংশে যা বলা হয়েছে তা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগী হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকে হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রবাসে সিট-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নসহ নানা জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে। তবে এটাও সত্য যেকোনো সংগঠনের কতিপয় নেতাকর্মী সমর্থক অপরাধে জড়ালে তার দায়ভার সংগঠনের ওপর বর্তায় না। সন্ত্রাসবিরোধী আইন তখনই প্রয়োগ করা যাবে যখন ওই সংগঠন সাংগঠনিকভাবে ওই ধরনের অপরাধে যুক্ত হওয়ার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করে। সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমকে তারা তাদের গঠনতন্ত্র ও ট্রেনিং দ্বারা উৎসাহিত করে এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর তার সদস্যদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে পদোন্নতি প্রদান করে, তাদের বাহাবা দেয় তখন। জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা বা আইএসয়ের কথা এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে। কিন্তু ছাত্রলীগের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে, যখনই ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তখন তারা ওই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে ওই সব নেতাকর্মীদের বিচার করার জন্য পুলিশের তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তাদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়েছে। এককথায় দলীয়ভাবে ছাত্রলীগ আল-কায়েদা বা আইএসয়ের মতো ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেনি। তাহলে আল-কায়েদা ও আইএসের মতো একই আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করলে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না এটাই স্বাভাবিক।
প্রজ্ঞাপনের পরের ধাপে যা বলা হয়েছে তা কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীলরা জেনে বুঝে বলেছেন নাকি কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কথা বলা দরকার তাই বলা তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। যদি জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্রলীগই শত শত মানুষকে হত্যা করে তাহলে কি যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একেবারে নির্দোষ ছিল সেই প্রশ্ন সামনে আসবে। এর মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের আগে ও পরের সব হত্যাকাণ্ডের দায় ছাত্রলীগের উপর চাপিয়ে অন্যদের কি দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে? জুলাই বিপ্লবে সরকারিভাবে এক হাজারেরও কম মানুষ নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। এর মধ্যে আবার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে নিহত হয়েছেন। বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে নিজের জান বাঁচাতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন এমন কথা কি পাগলেও বিশ্বাস করবে? তাই নিহত ব্যক্তির সংখ্যা, ঘটনা, স্থান, কাল-সময় ক্যালকুলেশন করে বক্তব্য প্রদান করলে পুরো বিষয়টি একটি গোয়বলীয় বিষয়ে পরিণত হবে। যার ফলে জুলাই বিপ্লবে নিহত প্রকৃত শহীদদের বিচারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রকৃত অপরাধীরা দায়মুক্তি পাবে। জুলাই বিপ্লবের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কোর্টের বিচার প্রক্রিয়ার বদনামও জুলাই বিপ্লবের বিচার প্রক্রিয়ার ঘাড়ে পড়বে। তাই সরকারের উচিত ছিল প্রথমে জুলাই বিপ্লবের পুরো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করা। ছাত্রলীগকে তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধ না করে অনন্তপক্ষে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিজস্ব জনসমর্থন রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের তুলনায় কম। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে এই সরকারের পক্ষে কি তাদের নিজস্ব সমর্থকদের নিয়ে রাজনীতির মাঠ দখলে রাখা সম্ভব। সহজ উত্তর হচ্ছে ‘না’। তাহলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রেখে সংস্কার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর ব্যতিক্রম হলেই জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই সরকারও বিগত সরকারে মতো হটে যেতে বাধ্য হবে। দিন দিন তাদের জনসমর্থন কমতে থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের প্রতি অবিশ্বাস জন্মাবে। যার ফলে তারা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিছিন্ন হয়ে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠবে এবং শেষে তাদেরও অপমানজনক বিদায় হবে।
উপর্যুক্ত সহজ সমীকরণ বোঝা দরকার সবার আগে। ওই সমীকরণে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের ফলে এই সরকার বিরাজনীতিকরণের পথে হাঁটবে কি না সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। ইতোমধ্যে বিএনপির কোনো কোনো নেতা তাদের দল নিষিদ্ধ করা হবে কি না সেই প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার নেতিবাচক দিক হচ্ছে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজনীতিকরণের আতংক তৈরি হবে; যা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও অবিশ্বাস বাড়াবে।
ইতোমধ্যে বিএনপির একজন নেত্রী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার ম্যান্ডেট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সত্যিকথা বলতে উপর্যুক্ত প্রশ্ন বেশ যুক্তিযুক্ত। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারের এই ম্যান্ডেট নেই। তাই ভবিষ্যতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই নিষিদ্ধ প্রজ্ঞাপন বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন হবে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে বা যিনি অথবা যারা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা ব্যক্তির দায় এবং সংগঠনের দায়ের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের রাজনৈতিক ঝুঁকিও তাদের চিন্তায় ছিল না বলে মনে হয়েছে। এই নিষিদ্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলোকেও আতংকিত করেছে বিএনপির নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়। এছাড়া এর মাধ্যমে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবে। সরকারের একজন উপদেষ্টার কথা মতো যদি ছাত্রলীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীরা চাকরিতে নিযুক্ত লাভের সুযোগ না পায় তাহলে তারা ঘরে বসে নিশ্চয় আঙ্গুল চুষবে না? জীবনবাজি রেখে এই সরকারকে হঠাতে রাজপথে নামবে। সত্যিকার অর্থে জীবনবাজি রেখে যদি তারা রাজপথে নামে তাহলে তা মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক শক্তি বা জনসমর্থন কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আছে? ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার আগে উপর্যুক্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার ছিল।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের চেয়ে ছাত্রলীগের যারা বিভিন্ন সময়ে অপরাধে জড়িয়েছে, সন্ত্রাসে জড়িয়েছে, দুর্নীতি করেছে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধুবাদ পেত এবং তাদের জনসমর্থন বাড়তো। কিন্তু এখানে-ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়া’ হয়েছে যা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/রন