শিক্ষকতা বাংলাদেশের সবচেয়ে নন-গ্ল্যামারাস পেশা। সবচেয়ে অলাভজনকও বটে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাও কোনো রকমে টিকে যান, বেতন ভাতা এবং চাকরি ও অবসরকালীন সুবিধাদির বিচারে পাবলিক ও কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটা সম্মানজনক জীবিকা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিতে পারেন। কিন্তু এর থেকে যতই নীচের স্তরে নেমে আসা যাবে, শিক্ষকতার মান-মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা ততই তলানিতে ঠেকতে থাকবে। কলেজ পর্যায়ের সরকারি শিক্ষকতা বা বিসিএস ক্যাডার তবু একরকম ঠিক আছে, যদিও বেতন নিয়ে তেমন অসন্তুষ্টি না থাকলেও উচ্চশিক্ষা ও পদোন্নতি নিয়ে আক্ষেপ আছে অধিকাংশ শিক্ষকের। এদিকে বেসরকারি কলেজ থেকে বেসরকারি স্কুল- সবখানে চরম নৈরাজ্য ও অসন্তোষ। এত এত অসন্তোষ নিয়ে শিক্ষকরা ছাত্র পড়াবেন কীভাবে? এই অসন্তুষ্টি কি তাদের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব ফেলে না? তার ফলে ক্ষতিটা হয় কাদের? ছাত্র-ছাত্রীদের, অর্থাৎ সারা দেশের মানুষের। আপনার সন্তানের স্কুলের শিক্ষক তার প্রাপ্যটা বুঝে পান না বলে ক্লাসে মনোযোগী নন, ফলে বাড়তি আয়ের জন্য তাকে কোচিং, প্রাইভেট ইত্যাদির দিকে ঝুঁকতে হয়। ফলে আপনার সন্তান স্কুল থেকে তেমন কিছু শিখতে পারে না বিধায় তাকে কোচিংয়ে দিতে হয়, প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়, হয়তো ওই স্কুল শিক্ষকটির কাছেই তাকে আবার স্কুলের বাইরে পড়তে হয়। তাতে আপনার যেমন বাড়তি টাকা খরচ হয়, আপনার সন্তানের খরচ হয় বাড়তি সময়, এনার্জি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলি।
আমার বড় কন্যাটি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়, ছয়টার মধ্যে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়, সাড়ে ছয়টায় তার স্কুল শুরু হয়ে যায়। স্কুল ছুটি হয় সাড়ে বারোটায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে একটা। গোসল এবং দুপুরের খাওয়া শেষ করতে করতে সে আর জেগে থাকতে পারে না, বিছানায় যেতে না দিলে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে যায়। কোনো কোনোদিন গোসল-খাওয়ারও আগে। সেই ঘুম থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে উঠে যেতে হয়, পাঁচটার মধ্যে আবার বেরুতে হয় কোচিংয়ের জন্য। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত টানা দুটো কোচিং করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা। এবার তাকে বসতে হয় স্কুল এবং কোচিং থেকে দেওয়া দুই দফা হোমওয়ার্ক করতে। সেসব শেষ করতে করতে বেজে যায় রাত বারোটা, একটা... রাত দুটো তিনটা পর্যন্তও তাকে পড়তে বা লিখতে দেখেছি আমি কোনো কোনো রাতে।
এত রাতে ঘুমিয়ে আবার ঘণ্টা দুই-তিন পরই উঠে পড়া, স্কুলে যাওয়া... আমি মোটামুটি নিশ্চিত, স্কুলের ক্লাসে সে জেগে থাকতে পারে না। হয়তো প্রবল চেষ্টায় চোখ খুলে রাখে, কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢোকে না, এক রকম ঝিমুনির মতো একটা ঘোর নিয়ে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বোর্ডের দিকে। বারো তেরো বছর বয়সী একটি মেয়ে যদি চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমায়, সেই সঙ্গে রোদ-বৃষ্টি-অসহ্য গরমের মধ্যে বাসা-স্কুল-বাসা-কোচিং-বাসা দফায় দফায় যাতায়াত করে, তার শরীরে এনার্জি বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে কি? মনোযোগ দেওয়ার মতো সামান্য ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকতে পারে তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে?
এই সমস্যা হতো না, যদি তার শিক্ষকেরা তাদের প্রাপ্য সুবিধাদি স্কুল থেকে ঠিকভাবে পেয়ে যেতেন। তাদের স্কুল এমপিওভুক্ত, যার অর্থ, সরকারের ‘মান্থলি পে অর্ডার’ স্কিমের আওতায় শিক্ষকদের বেতন মন্ত্রণালয় থেকে পরিশোধ করা হয়। এর নিয়ম হলো, মাস শেষ হলে, সেই মাসে কোনো শিক্ষকের উপস্থিতি, পারফরম্যান্স ইত্যাদির ওপর মূল্যায়ন মন্ত্রণালয়ে জমা হবে, সেটার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তার নামে চেক ইস্যু হবে। অর্থাৎ চেক হাতে আসতে আসতে আরও এক মাস সময় লেগে যায়। এভাবে জানুয়ারির বেতন ফেব্রুয়ারি পার করে মার্চ মাসে তাদের হাতে আসে।
প্রক্রিয়াটাতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মূল্যায়নপত্র জমা পড়তে বা অনুমোদন হতে প্রায়ই দেরি হয়, ফলে চেক আসতে সময় লেগে যায়। এই সুযোগটা নিয়ে ফেলে বড় বড় স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। যে বেতন সরকারি চেকের মাধ্যমে হওয়ার কথা, সেটা শিক্ষকদের পরিশোধ করা হয় স্কুলের অ্যাকাউন্ট থেকে, যার উৎস প্রকারান্তরে পরিচালনা পর্ষদ। শিক্ষকরা মাসের বেতন মাসের শেষেই পেয়ে যান, বিনিময়ে চেক এসে পৌঁছালে সেটা জমা দিয়ে দিতে হয় স্কুলের অ্যাকাউন্টে। এতে বেসরকারি শিক্ষকেরা, যারা মন্ত্রণালয়ের স্কিমের আওতায় শতভাগ বেতন পাচ্ছেন বলে সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে থাকছেন বলে সরকার আত্মপ্রসাদে ভুগছে, তারা আসলে ঠিকই বাধা পড়ে যাচ্ছেন পরিচালনা পর্ষদের হাতে- সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দীর্ঘসূত্রতার কারণে।
করোনার সময় যখন স্কুল সম্পূর্ণ বন্ধ, কঠোর লকডাউনে ঘরের বাইরে পা ফেলা নিষেধ, তখন স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষক ফোন করে বারবার তাগাদা দিতে থেকেছেন বেতনের জন্য, কেননা অভিভাবকরা ছাত্র-বেতন পরিশোধ না করলে শিক্ষকদের বেতন হবে না। আমি যখন জানতে চেয়েছি, আপনাদের বেতন তো সরকারি পে-অর্ডারে হয়ে থাকে এবং সেটা বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই, তাহলে কেন আপনি বেতনের দোহাই দিচ্ছেন? শিক্ষক আমার কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, সরকারি পে-অর্ডারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, ওটা পরিচালনা পর্ষদ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে রাখে, তাদের কাজ শুধু কয়েকটা সই করে দেওয়া। তাই এই করোনাকালেও বেতন তাদের অ্যাকাউন্টে ততক্ষণ পর্যন্ত ঢুকবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিচালনা পর্ষদ অন্তত নব্বই ভাগ ছাত্র বেতন নিজেদের অ্যাকাউন্টে বুঝে পাবেন।
এটা হলো বেসরকারি স্কুল পর্যায়ের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে মাত্র একটা। এরকম সমস্যার অন্ত নেই। কেবল বেসরকারি পর্যায় নয়, সরকারি পর্যায়েও সমস্যা লেগেই আছে, একটার পর একটা। প্রাইমারি হোক বা মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের নানা ট্রেনিং করতে হয়। সেই ট্রেনিং কোর্স হলো হয়রানির অপর নাম। ট্রেনিং সেন্টার (পিটিআই এবং অন্যান্য কেন্দ্র) একেকটা দুর্নীতির আখড়া। সেসব নতুন করে লিখার কিছু নেই, সবাই জানেন। যেসব কর্মকর্তা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ও পদোন্নতির বিষয়গুলো দেখেন,সেই সঙ্গে স্কুলগুলোর পারফরম্যান্স, বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা, ফলাফল ইত্যাদি মূল্যায়ন করেন- তারা যে ঠিক কোন গ্রহের বাসিন্দা, সেটা ভেবে বলা মুশকিল। আমার কয়েকজন সহপাঠী-বন্ধু এই পদগুলোতে আসীন। তাদের দুর্নীতি দেখলে আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে যাই- এরা আমার সহপাঠী ছিল?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশাপাশি বসে ক্লাস করেছি এদের সঙ্গে? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এই মূল্যবোধ তারা অর্জন করেছে? কিছু পেশার সঙ্গে দুর্নীতি, ঘুষ এসব একরকম জুড়ে গেছে, সেসব মেনে নেওয়ার মতো না হলেও গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ভাবা যায়, একটি স্কুলের বাচ্চারা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেবে বলে তাদের কোনোরকম খাত ছাড়া বাড়তি গুনতে হবে ন্যূনতম পাঁচশত থেকে কয়েক হাজার টাকা, যেটা চলে যাবে তাদের স্কুলের নিবন্ধন অনুমোদনকারী কর্মকর্তার পকেটে!
কর্মকর্তা টাকা নিচ্ছেন স্কুল থেকে, স্কুল নিচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে। কর্মকর্তা নিচ্ছেন পাঁচশত টাকা, সেই অজুহাতে স্কুল নিচ্ছে দুই হাজার টাকা!
এদিকে আরেক সমস্যা হলো শিক্ষকদের মাল্টিটাস্কিং। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে সরকার যাবতীয় জরিপ করিয়ে নিয়ে থাকে। গাছ গণনা, পশুশুমারি, কাঁচা ও পাকা পায়খানা গণনা, উপবৃত্তির টাকা ও খাবার বণ্টনের হিসাব থেকে নিয়ে গ্রাম পর্যায়ে অনেক ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানের ভিজিএফ ভিজিডি কার্ডের হিসাব-নিকাশের খাতাও পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরে। ক্ষমতাবানের চোখরাঙানির ভয়ে এই বাড়তি কাজগুলো ‘আন-অফিসিয়ালি’ তাদের করে দিতে হয় বৈকি। জন্মনিবন্ধন, বিবাহ-তালাক নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, টিকাদান কর্মসূচি- মাঠ পর্যায়ে যে মন্ত্রণালয়ের যত কাজ, তা বাস্তবায়নের মাঠকর্মী হলেন- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এই পদে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি কেন বুঝেছেন তো? নারীরা মুখ বুজে সব সহ্য করবে, চাকরি বাঁচানোর ভয়ে বিনা প্রতিবাদে সব করে দেবে, পাশাপাশি স্কুলের পড়াতো পড়াবেই।
বাংলাদেশে স্পেস সায়েন্টিস্ট নেই বা চোখে পড়ার মতো কেউ নেই কেন জানেন? দুর্দান্ত কোনো প্রোগ্রামার যারা অভাবনীয় প্রযুক্তি আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন- এমন কোনো বাংলাদেশি তরুণের কথা আপনি মনে করতে পারেন? বাংলাদেশ ফুটবল-হকি-অ্যাথলেটিক্সে একেবারেই কিছু করতে পারছে না কেন বলুন তো? কেন বিশ্বের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা নামমাত্র সংখ্যায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে? স্পেস সায়েন্টিস্ট হওয়ার জন্য যে অঙ্ক শিখতে হয়, সেটা মাধ্যমিকের নীচের ক্লাসের বই থেকেই শিখতে হয়। সেই অঙ্ক শেখানোর মতো যোগ্যতা আমাদের মাধ্যমিক বা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষকের নেই।
কোনো ছাত্রছাত্রীরও তাই সেসব সূত্রের সঙ্গে পরিচয়ই ঘটে না। দুর্দান্ত প্রোগ্রামার, প্রযুক্তিবিদ হতে গেলে যে কোডিং শিখতে হয়, যে ম্যাথ, ফিজিক্স এসব জানতে হয়, সেসব কিন্তু মূলত স্কুল থেকে শুরু করতে হয়। সিক্স-সেভেন-এইট থেকে। আশি-নব্বইয়ের দিকে আমি যখন স্কুলে পড়েছি, আমাদের অঙ্ক বইয়ে বাইনারি ছিল, যেটা আমার কোনো শিক্ষক পড়াতে পারতেন না, কারণ তিনি নিজেই কখনও পড়েননি। পড়েননি, কারণ সেটা ছিল সিলেবাসের বাইরে। আমার বড় ভাই সেই সিলেবাসের বাইরের চ্যাপ্টার নিজ আগ্রহে পড়ে বুঝে নিয়েছিলেন এবং আমাদের বুঝিয়েছিলেন। আমার খাতায় সেই অঙ্ক দেখে শিক্ষক আমাকে বকাঝকা করেছিলেন সিলেবাসের বাইরের পড়া পড়ে কেন সময় নষ্ট করছিস? অথচ দেখুন, এই বাইনারি সিস্টেম না শিখলে আপনি প্রোগ্রামিং, কোডিং, তথা কম্পিউটার সায়েন্সের অআকখ-টুকুও শিখতে পারবেন না।এই সবকিছুর মূলে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নিম্নস্তরের দুর্বলতা।
‘টপ হেভি, বটম লাইট’ কোনো কিছু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। যেটুকু সময় পারে, তাও খুবই সূক্ষ্ম ব্যালান্সের ওপর। একচুল নড়চড় হলেই ভূপাতিত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে টপ হেভি বটম লাইট। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে খোলতাই রোশনাই যাও বা একটু আছে, কিন্তু বটম তো নেই বললেই চলে!
আপনি হার্ভার্ড, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, এমআইটির ডিরেক্ট ক্যাম্পাস বাংলাদেশে খুলে দিন, তাতে লাভ কী হবে? কে ভর্তি হতে পারবে সেখানে?
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পলিটেকনিক ও বেসরকারি কলেজসমূহের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। কেউ বকেয়া বেতনের দাবিতে, কেউ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে, কেউ এমপিওভুক্তির আবেদন জানিয়ে। শিক্ষা ভবন, প্রেস ক্লাব, শহীদ মিনার, শাহবাগ চত্বর- বিভিন্ন জায়গায় তারা অবস্থান নিচ্ছেন, পুলিশ তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে লাঠিচার্জের ঘটনাও ঘটেছে। এমন ঘটনা বারবার ঘটতে দেখা গেছে বিগত সরকারের আমলেও।
২০২২ সালের শেষভাগে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মহাজোট এভাবেই প্রায় তিন সপ্তাহ অনশন আন্দোলন করেছিল জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচনের আগে তাদের কোনো দাবি মানার সুযোগ নেই। মনে পড়ছে, সে সময় পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল মৃতবৎ শিক্ষকদের হাহাকার- মানবেন কি মানবেন না পরের কথা, কেউ আমাদের কথা শুনবেন! হায়, শেষ পর্যন্ত কারোরই সময় হয়নি এই অবহেলিত ভাগ্যাহত শিক্ষকদের দাবিটুকু শোনার।
এক দেশে একই সিলেবাসে, একই সরকারের ছাপানো বই পড়াচ্ছেন দেশের সব শিক্ষক, তাদের মধ্যে কেউ সরকারি চাকরিজীবী, কেউ বেসরকারি। সিলেবাস, বইপত্র, শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় তো সরকারি-বেসরকারি বিভাজন নেই। সরকারি শিক্ষক যে বই থেকে যতটুকু পড়াচ্ছেন, বেসরকারি শিক্ষকও ততটুকুই পড়াচ্ছেন, কিছু বাদ দিচ্ছেন না, কিছু কম থাকছে না তার পড়ানোয়। তাহলে বেতন ভাতা, সুযোগ-সুবিধায় কেন এই আকাশ-পাতাল ফারাক? কেন জাতীয়করণ না করে তাদের ‘বিজাতীয়’ করে রাখা? যদি ওইসব বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও তার শিক্ষকদের সরকার স্বীকৃতি না-ই দেবে, তাহলে সেগুলো বন্ধ করে দিতে বলুক। জাতীয়করণের আওতার বাইরে কোনো কিছুকে সরকার চলতে দেবেই বা কেন? বরং সেগুলো তুলে দেওয়াই উচিত। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব নয় এই কারণে যে সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা তো বাংলাদেশেরই সন্তান এবং শিক্ষা তাদেরও মৌলিক অধিকার, যেটা সরকার নিশ্চিত করতে পারছে না তার সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায়।
তাহলে সরকারের কাজ করে দিচ্ছে যারা, সরকারের কাভারেজ নিশ্চিত করছে যারা, তাদের প্রতি সরকার হাত বাড়াবে না কেন? এটা মানি যে চাইলেই একটা বড় সিদ্ধান্ত এক কথায় নিয়ে ফেলা যায় না। এর সঙ্গে অর্থছাড়ের প্রশ্ন জড়িত, যেটা বিদ্যমান বাজেট থেকেই জোগাড় করতে হবে, যা অত্যন্ত দুরূহ একটা কাজ। কিন্তু তাই বলে কেউ তাদের সঙ্গে কথাই বলবেন না এতটা রূঢ়তাও কি প্রাপ্য?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতায় অর্জিত সরকার, রিসেট বাটনে পুশ করা নতুন বাংলাদেশের সরকারকে বলছি, সবকিছু রিসেট করার আগে রিসেট করুন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সংস্কার করুন সরকারি-বেসরকারি, উচ্চশিক্ষা-প্রাথমিক শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা-মাদরাসা শিক্ষা-কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদি নির্বিশেষে শিক্ষা ব্যবস্থার সব বৈষম্য। শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করুন এবং তা তাদের চাকরির বেতনের মাধ্যমেই করুন, যাতে শিক্ষকদের স্কুলের বাইরে কোচিং-প্রাইভেট টিউশন বাণিজ্যে জড়াতে না হয়।
আমরা আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবেই দেখতে চাই, তাদের স্কুল-কলেজের ক্লাসরুমেই দেখতে চাই; কোচিং সেন্টারে কিংবা খোলা রাজপথে বা প্রেস ক্লাবে আন্দোলন-অনশন মঞ্চে নয়।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক
ভোরের আকাশ/রন