পুলিশের অতিরিক্ত আইজি সেলিম মো. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি উল্টো মামলার বাদীকে চাপে রাখছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন জনৈক কবির হোসেন। তার শিশু ছেলে জাবির ইব্রাহিম গত ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এ ঘটনায় তিনি ২২ আগস্ট ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় সেলিম মো. জাহাঙ্গীর অন্যতম আসামি।
সূত্র জানায়, বাবা কবির হোসেনের সঙ্গে ছয় বছরের শিশু জাবির ইব্রাহিম গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ে গণভবন অভিমুখে লং মার্চে রওনা হওয়ার জন্য উত্তরা স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে জমায়েত হয় এবং বিকাল সাড়ে ৪টায় জমায়েতের ওপর আক্রমণ করে পুলিশ। পুলিশের ভয়ে শিশু জাবির নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এপিবিএনের উত্তর গেটের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে এপিবিএনের ভেতর থেকে বিজয় মিছিলের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা হয়। এ সময় বহু লোকের সঙ্গে শিশু জাবির এপিবিএনের বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। তার বাবা শিশু সন্তানকে বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করলেও লাভ হয়নি। গুলিবর্ষণের সময় এপিবিএনের প্রধান সেলিম মো. জাহাঙ্গীর এপিবিএন সদর দপ্তরে অবস্থান করে ফোর্সদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।
উত্তরা পূর্ব থানায় এপিবিএনের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীরসহ ১৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন কবির হোসেন। মামলা দায়েরের পর থেকে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বাদীকে নানা ধরনের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের জন্য নানামুখী চাপ দেন। অন্যদিকে উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মামলাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর আত্মগোপনে চলে যান এপিবিএনের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেশ কয়েকদিন পরে যোগদান করেন তিনি। প্রকাশ্যে শত শত এপিবিএনের সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলি চালানোর হুকুম দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেলিম মো. জাহাঙ্গীর। এই পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় মিডিয়ার সামনে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলেন এবং তার অধীনস্থ ফোর্সদের আন্দোলন দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে আসছিলেন। তার নির্দেশেই রাজধানীর চানখার পুল, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও বাড্ডা এলাকায় এপিবিএন সদস্যরা চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। যার ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। নিজেকে রক্ষায় অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মুগ্ধের ভাই সিগ্ধর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিগ্ধ ও তার বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে এপিবিএনে মুগ্ধের নামে একটি স্কুলের নামকরণ ও স্কুল গেট উদ্বোধনের সময় মুগ্ধের নামে দেওয়া হয়। এরপর এই চতুর পুলিশ কর্মকর্তা গত ৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দিয়ে ওই ভবন উদ্বোধন করান। নিজের অতীত কার্যক্রম মুছে ফেলতে এবং পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে গোপনে কাজ করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ৫ আগস্টের পর তার দীর্ঘদিনের ব্যবহ্নত ফেসবুক একাউন্ট ডিএ্যাকটিভ করে দিয়েছেন। তদন্ত করলে দেখা যাবে, তার মোবাইল ফোনে তৎকালীন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যেমন যোগাযোগ ছিল, অন্যদিকে ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল অসংখ্য সন্দেহভাজন ভারতীয় ব্যক্তি। কি কারণে হঠাৎ করে ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করা হলো বিষয়টি বিস্তারিত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা।
শহীদ জাবির ইব্রাহিমের বাবা কবির হোসেন বলেন, আমার ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর বিচার চাই। থানা পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছে, তারা মামলা তদন্ত করছে। কিন্তু আসামি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় তাদের তদন্ত নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গত অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীর আওয়ামী সরকারের সময় প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের জুন মাস পর্যন্ত চার বছর ডিএমপির ডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার এসপি, কক্সবাজারের এসপি থাকা অবস্থায় তিনি তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে র্যাবে বদলি হন। র্যাবের যাওয়ার পর তার র্যাবের ডাইরেক্টর ইন্টিলিজেন্স লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তখনকার র্যাবের ডাইরেক্টর ইন্টিলিজেন্স লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এর সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন। এক পর্যায়ে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি এনএসআইয়ে যোগদান করেন। তার এনএসআইয়ে যোগদানের নেপথ্যে কাজ করেন সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। মনিরুল ইসলাম ও জিয়াউল আহসান তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পোস্টিং করা হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ৬ বছর দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে মিনিস্টার (কনস্যুলার) হিসেবে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ভিসা প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে মিনিস্টার (কনস্যুলার) হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় র’য়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে তার কাজকর্ম ছিল ওপেন সিক্রেট। এর পুরস্কার হিসেবে র’য়ের উচ্চ পর্যায়ের তদ্বিরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহু পেশাদার, সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে সেলিম মো. জাহাঙ্গীরকে অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি দেন চলতি বছরের ২৮ মে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আসার পর সেলিম মো. জাহাঙ্গীরকে এপিবিএনের প্রধান করা হয়। এপিবিএনের অধীনস্থ ইউনিট এসপিবিএন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ের বিশেষ নিরাপত্তায় নিয়োজিত।
সেলিম মো. জাহাঙ্গীর মোবাইল ফোনে বলেন, সকল অভিযোগই মিথ্যা। একটি মহল ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি কখনই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ভারতে বাংলাদেশে দূতাবাসে নিয়োগটাও ছিল এক প্রকার শাস্তিমূলক পোস্টিং। ওখানে কেউ যেতে চান না। তিন বছর হওয়ার পর ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বলেন, আমি কখনই কোনো অন্যায়কে সমর্থন করিনি। এপিবিএনের ফোর্স বাইরে গেলে আমার কমান্ড দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ সদর দফতর। সাবেক এসবি প্রধান মনিরুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার কথা স্বীকার করলেও সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন।
ভোরের আকাশ/মি