আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে অনেকটা সচল রাখছে তৈরি পোশাক শিল্প। এইশিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে জীবিকানির্বাহ করছে লাখ লাখ মানুষ। বলা চলে বেকার সমস্যা অনেকাংশে ঘুচিয়ে দিয়েছে এই পোশাক শিল্প। অথচ এই শিল্পকে নিয়ে চলছে নানা ষড়যন্ত্র । ফলে এই শিল্পে বাড়ছে অসন্তোষ। প্রায় প্রতিদিনই এইশিল্পের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ে সড়ক অবরোধসহ নানা ঘটনা ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিতে সড়ক অবরোধ করে। এসময় পুলিশ বাধা দিলে তারা পুলিশ ও সেনা বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে বলে গত শুক্রবার দৈনিক ভোরের আকাশে খবর ছাপা হয়েছে। এছাড়া নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে করে এইশিল্প হারাচ্ছে বিদেশের বাজার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা বিরাজিত। সংবাদ মাধ্যমের সূত্র মতে, বিগত কয়েকদিন ধরে আশুলিয়া, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকায় রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা-ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষও ছিল দুঃখজনক। শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে উল্লেখ্য এলাকার পোশাকশিল্প ছিল কার্যত অচল।
আমরা জানি, দেশে বর্তমানে ৫ হাজার ৬০০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। কলকারখানা অধিদপ্তর এবং অ্যাকর্ড অ্যান্ড অ্যালায়েন্সের দেখভাল-তদারকির পরও এখন পর্যন্ত প্রায় ৫২ ভাগ কারখানায় শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। অন্তত ৪০ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানায় অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। ২৫ শতাংশ কারখানায় নেই নিরাপদ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা অথচ দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। পর্যায়ক্রমে হলেও এসব নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ফোরাম। এর আওতায় গার্মেন্টস কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে গঠন করা হচ্ছে জেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি। যেসব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় পোশাক কারখানা রয়েছে অথবা হতে যাচ্ছে, সে সবে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করতে এই কমিটি, যার নেতৃত্বে থাকবেন জেলা প্রশাসক। অবকাঠামোগত নিরাপত্তার বাইরেও বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম সমস্যা শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা। সময় সময় প্রধানত এ নিয়েই অশান্ত হয়ে ওঠে পোশাক শিল্প। সরকারি ফোরামের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও গঠিত হতে পারে এই জাতীয় ফোরাম, যাতে মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। তারাই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করে নিশ্চিত করবেন আর্থিক খাতসহ পোশাক শিল্পের সার্বিক নিরাপত্তা। সর্বোপরি শুধু গার্মেন্টস শিল্প নয়, বরং রপ্তানিমুখী অন্যান্য শিল্পেও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সের বাস্তবায়িত হওয়া আবশ্যক। পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন-সুবিধাদি প্রদান ও উৎপাদন গতিশীল রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অদৃশ্য অশুভ শক্তির চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে পড়তে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। বিদেশি ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করে বাংলাদেশের বাজার দখলে অন্যকোন দেশের অপতৎপরতা কার্যকর কিনা গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র অনুধাবন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তবে তারা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেতন বোনাসসহ নানা ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। এটা এই শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অন্তরায় বলে আমরা মনে করি। পশ্চিমা ক্রেতা, বাংলাদেশ সরকার, দাতা দেশ এবং সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও, শ্রমিকদের অধিকারের সমর্থক এবং ভোক্তা গোষ্ঠীগুলোকে অবশ্যই পোশাক শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আরো উন্নত করতে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে। কর্মী ক্ষমতায়নের এই উদ্যোগে কর্মীদের সন্তুষ্টি বাড়াবে, তবেই তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে, কর্মীদের অনুপস্থিতি হ্রাস করবে এবং কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্ব বাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হবে। এলক্ষ্যে সরকারকে নিতে হবে পরিকল্পিত উদ্যোগ। তবেই এই শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। কাজেই শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে এই স্লোগান বাস্তবায়ন জরুরি। শিল্প মালিক ও সরকার এই বিষয়টি ভেবে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ভোরের আকাশ/রন