logo
আপডেট : ৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:১৯
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল্যায়ন জরুরি
মেহেবুব সাহানা

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল্যায়ন জরুরি

বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান কী? রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কতটা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি? দক্ষিণ এশিয়ার সমসাময়িক এবং ভবিষ্যতের ভূ-রাজনীতিতে এই গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পরিবর্তন কতটা প্রাসঙ্গিক? যদিও অনেকেই এই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে তাৎক্ষণিক এবং আকস্মিক ঘটনা হিসেবে দেখেন, কিন্তু এর পেছনে বিশাল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলনে এত বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে আর কোথাও রাস্তায় দেখা যায়নি। অথবা, একবিংশ শতাব্দীতে কোনো রাষ্ট্রই তার সুশীল সমাজের প্রতিবাদ দমন করতে গিয়ে এত বিপুল রক্তপাত ঘটায়নি। এমনকি অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ফরাসি বিপ্লবের সময়েও এক শতাংশের বেশি মানুষ রাস্তায় নামেনি। সুতরাং, যদি কেউ মনে করে এই গণ-অভ্যুত্থান কেবল কোটা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল, তবে তা হবে একটি বড় ভুল। তাই এই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি।

অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেবল ব্যক্তিগত বা স্বৈরাচারী শাসকের পলায়ন হিসেবে দেখলে চলবে না। এ ঘটনাকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ভারতীয় ডানপন্থি, বিশেষত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পশ্চাৎপসরণ ও পরাজয়ের সঙ্গে যুক্ত করে বিশ্লেষণ করা উচিত। সহজ ভাষায়, শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর ঘটনাকে ভারতীয় হিন্দুত্ব রাজনীতির অখণ্ড ভারতের ধারণার ওপর একটি শক্ত আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং শেখ হাসিনার বাংলাদেশের ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশলে দিল্লির প্রভাবকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। প্রশ্ন হলো, ভারতের সহায়তায় এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়েই কি তিনি ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন? আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ইতিহাস এবং রাজনৈতিক দর্শনের সাহায্য নিতে হবে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সৃষ্টি হলেও পূর্ব পাকিস্তান কখনোই কলকাতার সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীতে বাংলা, বিহার, আসাম, ওড়িশা-জুড়ে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধুনিকতার যে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আন্তোনিও গ্রামশির হেজিমনি তত্ত্ব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার ওপর কলকাতার সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিবেচনা করলে বলা যায়, ধর্মীয় ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হলেও ভাষা, সাহিত্য, ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে পূর্ব বাংলা কখনোই কলকাতার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেনি। এ কারণেই পাকিস্তানি ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিকে পরাজিত করে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গড়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক বাংলার আধুনিকতা ও সাহিত্য অবিভক্ত বাংলায় এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে তা ১৯৭১ সালের ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ভিত্তি গড়ে তোলে।

যদিও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ নতুন পথচলা শুরু করে, তবে সাংস্কৃতিকভাবে বিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক আধুনিকতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। এর প্রতিফলন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত থেকে শুরু করে, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আজও দৃশ্যমান। এই আধুনিকতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি সেই সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই অগ্রসর হতে থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো, একবিংশ শতাব্দীতে যখন কলকাতা নিজেই তার সাংস্কৃতিক প্রভাব হারিয়ে দিল্লির আধিপত্যের আওতায় চলে গেছে, তখন এই শতাব্দীতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই বুড়ো কলকাতার বাঙালি সাংস্কৃতিক আধিপত্য কি এখনও প্রাসঙ্গিক? বিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এতটাই প্রভাব ছিল যে অসমীয়া ও ওড়িয়া ভাষাগুলোকেও বাংলার উপভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও এমনটি ভাবতেন। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই প্রভাব কোথায়?

এখন কেউ কি বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ অসমীয়া ও ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যে কতটা প্রাসঙ্গিক? একবিংশ শতাব্দীতে দিল্লির হিন্দি সংস্কৃতির আধিপত্য যে এই প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। হিন্দি সিনেমা এবং দিল্লির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব যখন ভারতের মধ্যেই কলকাতার বাঙালি সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে পিছনে ফেলে পুরোনো দিনের ধ্যান-ধারণার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তখন বর্তমান বাংলাদেশে সেই বিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্র আধুনিকতা কতটা প্রাসঙ্গিক?

আসল কথা হলো, বাংলাদেশের বর্তমান ‘জেনারেশন জি’ প্রজন্ম বিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক আধুনিকতার সঙ্গে বর্তমান ঢাকার ওপর দিল্লির প্রভাবকে ঠিক মেলাতে পারছে না। সমস্যাটি আরও গভীর হয় যখন আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সঙ্গে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সমন্বয় ঘটে। এই প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি অনেকের কাছে ভারতপন্থি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তাই শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে রবীন্দ্র আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নটি আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে, কেন বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীতের বিকল্প খুঁজছে? এটি কি শুধুই ইসলামপন্থি রাজনীতির উত্থানের ফল, নাকি এর পেছনে আরও গভীর একটি কারণ আছে, যেখানে ‘জেনারেশন জি’ বিংশ শতাব্দীর কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করতে চাচ্ছে না? অর্থাৎ এখানে রবীন্দ্র আধুনিকতার বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে গ্রামশির কাউন্টার-হেজিমনি তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। গ্রামশির কাউন্টার-হেজিমনি কী, এবং কেন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ও ইসলামপন্থিরা কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিজেদের সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের রাজনৈতিক ধারণার বিকাশ এবং ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

রণজিৎ গুহ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-উত্তর শাসন ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্যকে ‘ফড়সরহধহপব রিঃযড়ঁঃ যবমবসড়হু’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ, প্রান্তিক সমাজ বা জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতির বিরুদ্ধে আধিপত্য শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তবে, গত ৭৫ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের এই আধিপত্য কখনও কখনও রাজ্যের সুশীল সমাজের স্বীকৃতির বিরুদ্ধেও প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে কাশ্মির, মনিপুর ও বর্তমান ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্রের যে প্রভুত্ব এবং স্বৈরশাসনকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতবর্ষের ডানপন্থি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্বাস করে যে বৈচিত্র্যময় এই দেশটিতে রাজ্যের ওপর কেন্দ্রের আধিপত্য ছাড়া রাষ্ট্রের ঐক্য সম্ভব নয়। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতের মাটিতে ব্যাপকভাবে সফল হতে শুরু করলে, এই আধিপত্যের কৌশল প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরও প্রয়োগ হতে থাকে।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র “ঘবরমযনড়ঁৎ ঋরৎংঃ” হলেও নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থি চিন্তাধারার আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টার ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ফাটল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ফাটলের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার পলায়নকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

ভারতবর্ষে হিন্দুত্ব রাজনীতির মুসলিম বিদ্বেষ, মব লিঞ্চিং, ঈঅঅ এবং ঘজঈ বিল, অসম ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বাংলাদেশি সন্দেহে ভারতীয় মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাঁটাতার পেরিয়ে আগুনের ফুলকির মতো বাংলাদেশের জনসমাজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রিকেট ম্যাচ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অথবা আন্তর্জাতিক মঞ্চে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অনুসারীরা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করে, যা বাংলাদেশের সিভিল সমাজে শক্তিশালী হিন্দুত্ববিরোধী চিন্তাধারার উত্থান ঘটায়। এই হিন্দুত্ববিরোধী মনোভাব, দিল্লি ও ঢাকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে, বাংলাদেশে একটি ভারতবিরোধী আন্দোলনের রূপ নিতে শুরু করে। বাংলাদেশের এই নতুন সিভিল সমাজ মনে করে, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে হলে দিল্লির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হবে এবং বাংলাদেশকে রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক আধুনিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। যদিও ‘কাউন্টার-হেজিমনি’ গঠনের এই প্রক্রিয়াটি দুই দশক আগেই শুরু হয়েছে, তবে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যের পর এই প্রক্রিয়া অনেকটাই সফল হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। তবে ভারত এবং বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পারস্পরিক ইতিহাস বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে এই দুই দেশ পরস্পরকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণভাবে এগোতে পারবে না। যেমন, ভারত কখনোই বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে পারবে না, তেমনি বাংলাদেশও ভারতকে এড়িয়ে চলতে পারবে না। যদিও ভূ-রাজনীতি তার নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে, তাই ভারত ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে!

লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড।

 

ভোরের আকাশ/রন