রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ অথবা অপসারণ দাবিতে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গণভবনের সামনে বিক্ষোভ এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের কিছুটা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকের কাছে মনে হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি হয়তো শিগগিরই পদত্যাগ করবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অন্যতম প্রধান অংশীদার’ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক আব্দুল হালিম সম্প্রতি বলেছেন, তার দল রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায়। সেই সঙ্গে দেশের অন্যতম প্রধান ধর্মভিত্তিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ বা পদত্যাগের পক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটির নেতারা মনে করেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নিয়ে রাষ্ট্রপতি ‘মিথ্যাচার’ করে তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। সুতরাং তিনি এ পদে থাকতে পারেন না।
কিন্তু মুশকিল হলো, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের (অভিশংসন) ক্ষমতা আছে কেবল সংসদের। এ মুহূর্তে সংসদ নেই। ফলে তাকে অপসারণের সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই রাষ্ট্রপতিকে সরাতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিজে পদত্যাগ না করলে তাকে সরানোর সুযোগ নেই। আবার রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলেও সেখানে জটিলতা রয়েছে। কেননা সংবিধানের ৫০(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।’ কিন্তু কার্যত এখন স্পিকার নেই। কেননা ৫ আগস্টের পরে তিনি পদত্যাগ করেছেন। স্পিকারের অবর্তমানে তার দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার। কিন্তু তিনি কারাগারে। ফলে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, সেটি বিরাট প্রশ্ন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায়? এর কারণ স্পষ্টত দুটি।
১. মো. সাহাবুদ্দিন নিয়োগ পেয়েছিলেন সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংসদে এবং তিনি নিজেও এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ তাকে ‘আওয়ামী লীগের লোক’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। অতএব গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়ে তিনিও সরে যাবেন বা তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে এটিই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুক্তি।
২. আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অভিযোগ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যে কথা বলেছেন, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তার বিপরীত কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। সুতরাং শপথ ভঙ্গ করার মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। এমনকি এই ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেও সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে আইন উপদেষ্টা যা বলেছেন, তার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদ একমত। এসব কারণে অনেকের মনেই এই ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি হয়তো সরে যাবেন কিংবা এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হবে যাতে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু এই ইস্যুতে জটিলতা তৈরি করেছে সাংবিধানিক বিধান এবং বিএনপির কৌশলী অবস্থান।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এ মুহূর্তে দেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। আগামী ছয় মাস বা এক দেড় বছরের মধ্যে অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে যে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে সে বিষয়ে বোধ হয় কারো সন্দেহ নেই। সুতরাং যেকোনো বিষয়ে বিএনপির অবস্থান এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং কোনো ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা দেখতে চায় না বলে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে। তার মানে প্রধান উপদেষ্টার ভাষায় যে ছাত্ররা তাদের ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’, তাদের জোরালো দাবি এবং জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থানের পরও বিএনপির ভিন্ন অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রপতি হয়তো টিকে গেলেন, এমনটাই মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সরে গেলে বা পদত্যাগ করলে কে রাষ্ট্রপতি হবেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাকে নির্বাচিত করা হবে, সেটি আরেক জটিলতা। কেননা রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ দেয় সংসদ। এ মুহূর্তে সংসদ নেই।
সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ বলছে: ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।’ কিন্তু স্পিকার না থাকায় এখন কারো পক্ষে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়া সম্ভব নয়।
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্পিকারের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্বপালনে অসমর্থ্য বলে সংসদ নির্ধারণ করলে তার সব দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু) গত ১৫ আগস্ট গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি এখন কারাগারে।
কিন্তু পরক্ষণে ৭৪(৬) অনুচ্ছেদ এও বলা হয়েছে যে, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলিয়া গণ্য হবে। এই যুক্তিতে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগ করলেও কিংবা কারাগারে থাকলেও পরবর্তী সংসদে তাদের উত্তরাধিকার নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল আছেন বলেও ধরে নেওয়া যায়। অন্তত ডেপুটি স্পিকারের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায়। যেহেতু তিনি পদত্যাগ করেননি এবং বিচারের রায়ে শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধীও বলা যাচ্ছে না।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর স্পিকার হচ্ছেন রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী। সংসদ ভেঙে দিলেও তার পদ যায় না। পদত্যাগ করলেও নতুন স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি পদে আছেন বলে ধরে নিতে হয়। পরবর্তী সংসদের সদস্যদের শপথ পড়ানোর ভার তার ওপরই বর্তায়। এমনকি রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারকেই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার নিতে হয়। এই যুক্তিতে এখনও অর্থাৎ পরবর্তী সংসদ না বসা পর্যন্ত স্পিকার তার পদে বহাল আছেন বলে অনেক আইনজ্ঞও মনে করেন। কেননা সংবিধানে সবকিছু লিখিত থাকে না। কিছু থাকে কনভেনশন। সেই কনভেনশনের আলোকেই এটা মনে করা হয় যে, স্পিকার পদত্যাগ করেলও তিনি এখনও তার পদে আছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন তাহলে সদ্য পদত্যাগী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কিংবা কারাবন্দি ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর মধ্যে কেউই রাষ্ট্রপতির ভার গ্রহণ করবেন না বা তাদেরকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হবে না। কেননা যে যুক্তিতে মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করা হচ্ছে, সেই একই যুক্তি স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে যেহেতু তারা আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন তাহলে তাকে এ মুহূর্তে আইনি প্রক্রিয়ায় অপসারণের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যদি সত্যি সত্যিই পদত্যাগ করেন অথবা তিনি যদি শারীরিকভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন কিংবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে যদি তার মৃত্যু হয়, তখন কী হবে? তখন একটি সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে এবং সরকারকে তখন সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ সংবিধানে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকলেও যেহেতু সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিয়ে দেশের একটি সংকটকালে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে, একই প্রক্রিয়ায় একজন নতুন রাষ্ট্রপতিকেও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কে হবেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি, সেই ইস্যুতে হয়তো কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান মেলেনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যস্থা চালু করবেন, এ রকম একটি আলোচনাও বাতাসে ভাসছিল। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এর কিছুই হবে না। কেননা রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান শক্তি সেনাবাহিনীরও হয়তো গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যায়নি।
এখানে আরেকটি বড় জটিলতা হচ্ছে, যেহেতু সংসদ নেই, অতএব রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে এবং হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে। সুতরাং রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিলে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত যদি কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় সেটি কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, সেটিও প্রশ্ন। এ রকম নানাবিধ জটিলতায় চক্রে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ অথবা অপসারণের ইস্যুটি হয়তো আটকে গেছে।
মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রপতি তার পদে থাকলেন কি থাকলেন না অথবা তিনি পদত্যাগ করলে পরবর্তীতে এই পদে কে বসবেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাকে নির্বাচিত করা হবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দেশ যে একটি বিরাট সংকটের ভেতরে পড়েছে; দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার চিন্তিত; যেহেতু সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়, আবার বিএনপির মতো দল দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ক্রমেই তাদের উচ্চারণ জোরালো করছে, ফলে সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্বটি পালন করতে পারছেন কিনা অথবা এই মুহূর্তে তার কাজের এখতিয়ারই বা কতটুকু, এসব প্রশ্নের সুরাহা করা আরও বেশি জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন