ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে গত ১ নভেম্বর আবাসিক ভবনে হামলা চালানো হয়। এই দিনে ইসরাইলি বিমান হামলায় ৫০ জনের বেশি শিশুসহ নিহত হয় ৮৪ জন। এই হামলাকে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ বলে দাবি করেছে অনেকে। ফিলিস্তিনে কি ঘটছে এবং কি ঘটতে যাচ্ছে, তা অনুমান করে বিশ্ব হতবাক। ফিলিস্তিনে এসব হামলার ঘটনা কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়? বিশ্বে এখন মানবিকতা কোথায়? ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে আছে।
বিশ্ব নেতারা কি করছে? এই সংকট মোকাবিলায় কেন কোনো ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই আমরা, শুধু নিন্দা জানিয়ে এই অন্যায় হামলার স্বরূপ বোঝানো যাবে না। ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু যারা এই কাজটি করবে বলে আমরা আশা করি, সেই পাশ্চাত্য দেশগুলো হামলার পেছনে প্রচ্ছন্ন ইন্ধন জুগিয়ে চলছে!
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন মুখে যুদ্ধ বিরতির পক্ষে সমর্থন জানালেও ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। অতীতে দেখা যায় যুদ্ধ বিরতির পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করার পর নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথোপকথন করেন বাইডেন। এখন পর্যন্ত নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় কমপক্ষে ৪৩ হাজার ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। শিশুদের কান্নার আহাজারি দেখেও কি বিশ্ব নেতাদের মনে হয় না যে, এই হত্যাযজ্ঞ অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার? আর কত প্রাণহানি হলে বিশ্ব নেতাদের এবং জাতিসংঘের ঘুম ভাঙবে?
ফিলিস্তিনে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিমান হামলা ও বোমা বর্ষণ করে চলেছে ইসরাইল। নির্বিচারে হত্যা করছে নারী, শিশুসহ বেসামরিক লোকজনকে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে গোটা গাজা নগরীকে। উগ্র ইহুদিদের আক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছে না দাতব্য কার্যক্রম, মিডিয়া কার্যালয়, আবাসিক ভবন। এমনকি স্কুল ও হাসপাতালে টানা বিমান হামলা চালাচ্ছে তারা। হত্যাযজ্ঞে মত্ত ইসরাইল বিভিন্ন এলাকা অবরুদ্ধ করে অব্যাহত বিমান হামলার কারণে সেখানে উদ্ধারকর্মীরা যেতে পারছে না।
ওইসব এলাকায় কোনো ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবা কিংবা ত্রাণ সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিমান হামলা থেকে রক্ষা পায়নি গাজার হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বন্ধ হয়ে গেছে হাসপাতালের কার্যক্রম। এ আগ্রাসনকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা প্রয়োজন।
ইসরাইলের এসব বর্বর হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন আইনজ্ঞরাও। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আরদি ইমসেইস বলেছেন, গাজা উপত্যকার অসমর্থিত বাহিনীর মোকাবিলায় ইসরাইল যা করছে, তা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ। তিনি বলেন, ‘ইসরাইল প্রাথমিকভাবে স্বাতন্ত্র্য, আনুপাতিকতা ও সতর্কতার নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে যুদ্ধাপরাধ করছে, তা বিশ্বাস করার মতো বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে।’
এ রকম যুদ্ধবিগ্রহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকলে বিপন্ন হয়ে পড়বে মানবতা। ইতোমধ্যে যে সংখ্যক শিশু মারা গেছে তাতে প্রমাণিত যে, এদের মনে মানবতার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। তাই এখনই উচিত হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে কোনো সমাধানের পথ বেছে নেওয়া। আক্রমণ নয়, পাল্টা আক্রমণ নয়, বিশ্বনেতা ও রাজনীতিবিদদের উচিত দুই জাতির এই বিবাদের সঠিক ও স্থায়ী মীমাংসা করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজায় লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অনেক মানুষ। কি ভয়াবক অবস্থা! জাতিসংঘ এসব বিষয়ে অবগত। তাহলে তারা কেন এই সংঘর্ষ থামাচ্ছে না? এই বিশ্ব সংস্থা কিসের জন্য তৈরি করা হয়েছে? এর কি কোনো ভূমিকা নেই? তাহলে এই ধরনের সংগঠনের কোনো প্রয়োজন আছে কিনা? তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক স্থানে ইসরাইলবিরোধী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। প্রতিবাদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন ছিল। মানুষ তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ধর্ম দিয়ে কোনো পরিচয় নয়, পরিচয় হলো মানুষ।
বিশ্বের সবাই মানুষ। সবাইকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। একমাত্র সবাই সোচ্চার হলে পৃথিবী থেকে এই ধরনের অন্যায়, অত্যাচার বন্ধ হবে। অন্যথায় এই ধরনের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড চলতেই থাকবে। জাতিসংঘের উচিত, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অবিলম্বে এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করা। ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের ওপর ইসরাইলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে গাজায় জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষী পাঠানো উচিত বিভিন্ন দেশের। জাতিসংঘের উচিত হবে বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ অবিলম্বে বন্ধ করা।
ফিলিস্তিনিদের যেকোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদকে কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে থাকে। এই রীতি অনেক পুরনো। তারা কোনো সভা বা সমাবেশ করলে এটাকে বলা হয় সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর সম্মেলন। তাদের ভূখণ্ডে ইসরাইলিরা বিল্ডিং তৈরি করতে গেল, জমি দখল করতে গেল, এতে কোনো সমস্যা নেই এবং বিশ্ব মিডিয়াতে তা প্রকাশ পায় না। বরং তারা প্রতিরোধ করলে, তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ফলে, ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিচার থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
ফিলিস্তিনের জাতিগত মুক্তি সংগ্রামকে ইসলামের সঙ্গে মিলিয়ে না ফেলে ফিলিস্তিনিদের শুধু ‘মুসলমান’ হিসেবে না দেখে, তাদের প্রকৃত মানুষ ভেবে নিরীহ শিশু হত্যা এবং গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া উচিত। সর্বোপরি বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হোক, মানুষের মাঝে শুভ চিন্তার উন্মেষ হোক, শান্তি ফিরে আসুক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ