২৪ বছর বয়সী নরসিংদীর বেলাবোর মো. আব্দুর রহিম দরিয়া। পরিচিত এক চাচার প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত নেন সমুদ্রপাড়ি দিয়ে ইতালি যাবেন। ১০ লাখ টাকা খরচ করে সেই লক্ষ্যে আব্দুর রহিম প্রথমে বাংলাদেশ থেকে দুবাই যান। দুবাই থেকে সিরিয়া, সিরিয়া থেকে যান লিবিয়ায়। সেখানে ৩০০ জনের একটি দলের সঙ্গে ছয় মাস একটি কক্ষে তাদের বন্দি করে রাখা হয়। পরে তাদের দিয়ে গায়ে শিহরণ জাগানো একটি ‘গেম’ পরিচালনা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিযাত্রাকে দালালেরা বলেন ‘গেম’। এই গেম কখনও ছোট নৌকা, কখনও জাহাজের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এসব নৌযানে গাদাগাদি করে গেমে অংশ নেন অভিবাসনপ্রত্যাশী লোকজন। ভাগ্য ভালো হলে তরী ভেড়ে তীরে, না হলে সলিলসমাধি। ভয়ংকর সেই গেমে অংশ নেন আব্দুর রহিমও। তার সঙ্গে ছিলেন বেলাবোর ৯ জন। ভয়াবহ সেই সাগরযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
আব্দুর রহিমের মতো বাংলাদেশ থেকে শত শত যুবক বর্তমানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা এই পথে পা দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন- তাদের সহজ উত্তর, যদি কোনোভাবে সেখানে পৌঁছানো যায়- তাহলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরিবার ও নিজের সুখের চিন্তায় উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদের যেতেই হবে ইতালি!
গমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছেছেন এমন ১৩ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয়। বর্তমানে তারা ইতালির রোম, ভেনিস ও মিলান শহরে অবস্থান করছেন। তারা জানান, ঢাকা থেকে ২-৩টি রুটে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়া যায়। তবে, অধিকাংশই ঢাকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই হয়ে লিবিয়ায় যান। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশ করেন। কেউ কেউ আবার তিউনিসিয়া হয়েও ইতালি পৌঁছান।
বাংলাদেশি প্রবাসীরা জানান, তাদের সবাইকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে লিবিয়া নেওয়া হয়। এজন্য তাদের আট থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। বাংলাদেশি দালালেরা এই টাকা নেন। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর প্রায়ই তাদের জিম্মি করে নির্যাতন করা হয়। অতিরিক্ত আরও তিন থেকে চার লাখ টাকা আদায় করা হয়। পরে তাদের ইতালি সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্পিডবোট বা জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। তারা আরও জানান, ইতালি যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের সঙ্গে দালালদের একটি চুক্তি হয়। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, কোনো বাংলাদেশি যদি লিবিয়াতে বা সমুদ্রপথে বা ইতালি পুলিশ বা কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেপ্তার হন বা জেলে যান; সেক্ষেত্রে মুক্তির খরচ ওই বাংলাদেশিকেই বহন করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, গ্রেপ্তার হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আন্তর্জাতিক মানব পাচারের রুট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকা থেকে সমুদ্রপথে ইতালি যেতে দুটি রুট সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। একটি ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়া এবং আরেকটি ঢাকা থেকে তুর্কিস্তান হয়ে লিবিয়া। এরপর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির সীমান্তে পৌঁছানো। তাদের মতে, ফ্রেশ পাসপোর্ট (পাসপোর্টে কোনো ভিসা লাগেনি) থাকলেও ওই দুই দেশ তাদের ভিসা দেয়। ন্যূনতম শর্ত মেনে আবেদন করলেই ভিসা মেলে। এ কারণে দালালেরা এই রুটে বাংলাদেশিদের নিয়ে যায়। এ ছাড়া সমুদ্রপথে লিবিয়া যেতে আরও তিনটি রুট রয়েছে। দালালেরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঢাকা থেকে প্রথমে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক নিয়ে যায়। ব্যাংকক থেকে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া এবং সেখান থেকে টোগো হয়ে লিবিয়া। অবশেষে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি। এ ছাড়া ঢাকা থেকে মিশরের কায়রো এবং ভারতের মুম্বাই হয়েও লিবিয়ায় পাড়ি দেন অনেকে।
ভারত হয়ে ইতালিতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, প্রথমে ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা সংগ্রহ করা হয়। পরে তাদের ঢাকা থেকে শ্যামলী বাসে করে ভারতের কোলকাতা নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফ্লাইটে সেদিনই মুম্বাই নেওয়া হয়। মুম্বাইয়ে সাত দিন থাকার পর উড়োজাহাজে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়।
মানব পাচার নিয়ে কাজ করা সিআইডির একটি দল জানায়, বর্তমানে অনেকে লিবিয়া থেকে সরাসরি ইতালি না গিয়ে তিউনিসিয়া যাচ্ছেন। সেখান থেকে ইতালি রওনা হচ্ছেন। সমুদ্রে কোস্টগার্ড কখন, কোন দিকে টহল দেয়; সেটির ওপর গেমের রুট নির্ভর করে।
ঢাকা থেকে স্বপ্নের ইতালি ভ্রমণে এমনিতেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার মতো মৃত্যুঝুঁকি নিতে হয় প্রত্যেককে। তবে, এর আগের পথটাও সহজ না। এই রুটে পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার হন। নিখোঁজও হন অনেকে। ২০২৩ সালের জুন মাসে ইতালির উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া শাওনকে এখনও খুঁজছে তার পরিবার। শাওনের ভাই মো. সোলাইমান জানান, ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়ে সর্বশেষ আলজেরিয়া পৌঁছেছিল শাওন। বাসায় জানিয়েছিল, আলজেরিয়া থেকে মরুভূমি দিয়ে তিউনিসিয়া যাবে। এরপর সেখান থেকে ইতালি। তবে, যাওয়ার পথে সে নিখোঁজ হয়। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তার খোঁজ পায়নি পরিবার।
ইতালির রোম শহরে সঙ্গে সহুল নামের এক ভুক্তভোগীর কথা হয়। তিনি বলেন, আমি আট লাখ টাকার চুক্তিতে এসেছিলাম। আমাকে লিবিয়ায় নির্যাতন করে ধাপে ধাপে আরও ১৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। লিবিয়ার সীমান্তে দুবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। সেখানেও টাকা লাগে। পরে পরিচিত দালালের মাধ্যমে ছাড়া পাই। সবমিলিয়ে গত তিন বছরে ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এরপর ইতালি আসতে পেরেছি। টাকা সংগ্রহের জন্য জায়গাজমি, বাড়িঘর এমনকি ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হয়েছে। লিবিয়ায় একবার ধরা খেয়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম। তবে, দালালেরা ফিরতে দেয়নি। তখন বুঝেছিলাম যে আমি পাচারের শিকার হয়েছি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মানব পাচারকারীরা জানায়, লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির মাঝে বীর ঘনাম নামে একটি ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে অধিকাংশ বাংলাদেশিদের রাখা হয়। তারা জানান, নারী-পুরুষ ও শিশুদের এখানে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়। টাকা না দিলে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। একজনকে হত্যা করে অন্যজনকে দেখানো হয়। যারা ভালো দালালের মাধ্যমে যায় তাদের রাখা হয় ত্রিপলি শহরের আবু সিত্তাহ, আল-সাহেল ও আল-জ্বালা এলাকার ফ্ল্যাটে। সেখানেও তাদের নির্যাতন করা হয়।
২০২৪ সালের মার্চে লিবিয়ায় রুবেল হোসেন নামের এক বাংলাদেশিকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। তার হাত-পা ও মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। সেই ভিডিও বগুড়ার আমেশ্বপুর নিশিপাড়া গ্রামে তার স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে পাঠানো হয়। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয় ১০ লাখ টাকা। লিবিয়া বা তিউনিসিয়া থেকে মূলত ছোট বা বড় স্পিডবোট এবং মাঝারি আকারের জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রপথে ইতালির উদ্দেশে রওনা দেন ভুক্তভোগীরা। ছোট স্পিডবোটের ধারণক্ষমতা ১২ জন এবং বড়টির ২০ জন। তবে, ‘গেম’ দেওয়ার সময় ১২ জনের স্পিডবোটে ৩৫ থেকে ৪০ জন এবং বড় স্পিডবোটে ৭০ থেকে ৮০ জনকে নেওয়া হয়। মাঝারি আকারের জাহাজের ধারণক্ষমতা ১০০ থেকে ১২০ জন হলেও এতে গাদাগাদি করে সর্বোচ্চ ৩০০ জনকে নেওয়া হয়।
লিবিয়া হয়ে ইতালি পাড়ি দেওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিষয়ে মো. আব্দুর রহিম দরিয়া বলেন, আমরা ৩৯ জন বাংলাদেশিসহ ১৫০ জন ছিলাম একটি ছোট জাহাজে। সেখানে কাউকে খেতে দিত না, এমনকি পানিও দিত না। আমরা প্রস্রাব করে জাহাজের ট্যাংকের ভেতরে ফেলতাম। সেটাই পানি হিসেবে আমাদের খাওয়ানো হতো। আমাদের পলিথিন নিয়ে যেতে হতো। মলত্যাগের পর সেই পলিথিন ড্রামে ফেলা হতো।
চলতি বছরের ১৭ জুন ইতালির দক্ষিণ উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দুটি নৌকা ডুবে যায়। এতে ১১ বাংলাদেশি নিহত হন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০২৪ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পথে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ১৬ হাজার ২০০ নাগরিক এই পথ দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন। তবে, গত ১০ বছরে সুখের খোঁজে বের হয়ে সমুদ্রে ডুবে ২৮৩ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৬৯ জন সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন। তাদের মধ্যে ২৩ শতাংশই বাংলাদেশি নাগরিক, সংখ্যায় দুই হাজার ৬৭০ জন। ২০২১ সালেও এই তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালে ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে, ২০২২ সালে ছিল তৃতীয় এবং ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশ্লেষক এবং আইওএমের সাবেক কর্মকর্তা আসিফ মুনীর বলেন, সমুদ্রপথটা এমনিতেই অবৈধ। এই পথে রয়েছে প্রচুর ঝুঁকি, নিয়মিত মৃত্যুও হচ্ছে। তারপরও সবকিছু জেনে ও বুঝে অনেকে পথটা বেছে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে অনেকে বৈধভাবেও ইতালি যাচ্ছেন। তবে, এমন শহরে যাচ্ছেন যেটা অভিবাসনবান্ধব না। সবমিলিয়ে বিষয়টা সরকারিপর্যায় থেকে সুরাহা করতে হবে।
মোটা দাগে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে ইতালি পাড়ি দেওয়াদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল ও বরগুনার বাসিন্দারা। তবে, গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা দুই হাজার ২৮৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। তাদের তথ্য মতে, এই পথ বেছে নেওয়াদের অধিকাংশই সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বাসিন্দা। তারা সর্বনিম্ন তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-৩ শাখার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত মানব পাচার সংশ্লিষ্ট সারা দেশে তিন হাজার ৯৪৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ৩৬ হাজার ৮২৯ জনকে আসামি করা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৯০২ জন।
সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের প্রধান (সদ্য অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সরদার রোকনুজ্জামান বলেন, এই ধরনের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে পাচ্ছি। অবৈধ পথ বেছে নিয়ে কেউ কেউ মারাও যান। কেউ-বা বিভিন্ন দেশের পুলিশের হাতে আটক হন। অথচ খুব অল্পসংখ্যক ঘটনাই বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আসে। যারা মামলা করেন, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করি, চার্জশিট দেই। এসব অভিযোগে কাউকে তিল পরিমাণ ছাড় দেওয়া হয় না, আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ মামলা করেন না। দালালেরা তাদের ফুসলিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখে।
ভোরের আকাশ/রন