আমাদের দেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দিনদিনই এই সমস্যা জটিল ও প্রকট হচ্ছে। অথচ এই সমস্যা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না জোরালো কোনো উদ্যোগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, কমনওয়েলথসহ একাধিক সংস্থার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, যেখানে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বেকার সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে বলে আমরা মনে করি। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকার মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটিরও বেশি। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হারই বেশি। আমরা মনে করি, কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। বর্তমান বাংলাদেশে এই সমস্যা জটিল ও প্রকট আকার ধারণ করেছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কর্মহীন এই বিশাল উদ্বৃত্ত জনশক্তি না পারছে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে, না পারছে নিজের সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে। বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা। ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা সমাধানে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেকোনো সময় ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে বলেই আমাদের আশঙ্কা। গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে এই মর্মে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪২ শতাংশ তরুণ বেকারত্ব নিয়ে খুব চিন্তিত। তারা মনে করেন, বেকার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে বৈষম্য এবং পরিবারের সঙ্গে কাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারা। এ কারণে ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে যেতে চাচ্ছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের "নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪" নামে এক গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মিলনায়তনে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩ হাজার ৮১ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে তরুণদের মধ্যে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ কিছুটা কমে গেছে। ২০১৫ সালে ৬০ শতাংশ তরুণ বলেছিলেন, তারা বিশ্বাস করেন দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে, কিন্তু ২০২৩ সালে এই হার নেমে এসেছে ৫১ শতাংশে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৩৭ শতাংশ বলেছেন, বেকারত্বের সবচেয়ে বড় কারণ দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ। ২০ শতাংশ তরুণ নিয়োগে বৈষম্য এবং ১৮ শতাংশ পারিবারিক জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে না পারাকে দায়ী করেছেন। এছাড়া, ৪৪ শতাংশ তরুণ আগামী এক বছরের মধ্যে নিজের ব্যবসা শুরু করতে চান। তারা মনে করেন, নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এটি একটি ভালো উপায়। তরুণদের মধ্যে ৭২ শতাংশ বলেছেন, তারা ৭ জানুয়ারি হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী ছিলেন। তবে ৬৫ শতাংশ তরুণ নিজেদের রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পথে বেকার সমস্যা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। এই নিয়ে কালক্ষেপণ করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। এই নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বেকার মানুষের নানামুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করে তুলতে হবে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে, যাতে বেকার যুবকরা সহজেই এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। মনে রাখতে হবে দক্ষ জনশক্তিই বেকার সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে দিতে পারে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা সেই দৃষ্টান্তই দেখতে পাই। তাই বেকারত্বের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয়করণের মনোবৃত্তি পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বেকারত্ব থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সরকার সেই লক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন