logo
আপডেট : ৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১৭:১৪
সাগরের অতলে
‘পিরামিড শহর’
ভোরের আকাশ ডেস্ক

সাগরের অতলে

সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে আস্ত একটা ‘পিরামিড শহর’! যাকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। কারা এর সৃষ্টিকর্তা? কীভাবেই বা সলিলসমাধি ঘটল গোটা একটা নগরের? সেই রহস্যের কূল-কিনারা পেতে চলছে নিরন্তর গবেষণা। আর অন্য দিকে সাহসীরা জলমগ্ন শহরের গলিঘুঁজিতে ঘুরতে ডুব দিচ্ছেন সাগরের অতলে। তাইওয়ান সংলগ্ন জাপানি দ্বীপ ‘ইয়োনাগুনি’। যেখানকার সমুদ্রের মূল আকর্ষণ হলো, ‘হ্যামারহেড’ হাঙর। জলের সেই দৈত্যকে চাক্ষুষ করতে ফি বছর অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা দ্বীপের সমুদ্র উপকূলে ভিড় জমান। তারপর ডুবুরির পোশাক গায়ে চড়িয়ে ডুব দেন সাগরের অতলে। যা করতে গিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে এক দিন খোঁজ মেলে জলমগ্ন পিরামিড শহরের। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।

ইয়োনাগুনির স্থানীয় পর্যটন সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন কিশারিয়ো আরাটেক। ১৯৮৬ সালের এক শীতের দুপুরে ওই দ্বীপ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে ডুব দেন তিনি। সমুদ্রের যে অংশটি হ্যামারহেড হাঙরদের লীলাক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত, সেখানে পৌঁছেই একটি প্রাণীকেও দেখতে পেলেন না তিনি। তখন আরও গভীরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আরাটেক। সাগরের আরও গভীরে নামতেই পাহাড়ের মতো উঁচু একটি স্থাপত্যের হদিস পান কিশারিয়ো। প্রথমটায় একে জলমগ্ন টিলা বলে মনে হলেও, কিছু ক্ষণের মধ্যেই ভুল ভাঙে তার। আরাটেক বুঝতে পারেন, আস্ত একটা শহর লুকিয়ে রয়েছে জলের তলায়। সেখানে পিরামিড আকারের রাস্তা আর স্টেডিয়ামের মতো বড় স্থাপত্য বিদ্যমান। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই দ্রুত দ্বীপে ফিরে আসেন কিশারিয়ো। তার আবিষ্কারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জাপানের সুবিখ্যাত ‘রিউকিউস’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন তিনি। যা পড়ে এ ব্যাপারে তত্ত্বতালাশে নামেন সমুদ্র-ভূবিজ্ঞানী মাসাকি কিমুরা। তিনি ওই জলমগ্ন পিরামিডের শহরকে হারিয়ে যাওয়া ‘এমইউ’ মহাদেশের অংশ বলে দাবি করে বসেন। কিমুরাসহ বেশ কিছু ভূবিজ্ঞানীর যুক্তি ছিল, জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে সুপ্রাচীন ওই শহরের সলিলসমাধি ঘটেছে। মজার বিষয় হলোÑ বিশ শতকে মাঝামাঝি থেকেই সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরের খোঁজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু জায়গায় যার হদিসও মেলে। ফলে অচিরেই সেই তালিকায় নাম জুড়ে যায় দ্বীপরাষ্ট্রের হারিয়ে যাওয়া পিরামিড শহরের।

১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েল সংলগ্ন ভূ-মধ্যসাগরে জলের ৪০ ফুট নিচে আস্ত একটা গ্রামের খোঁজ পান ভূ-বিজ্ঞানীরা। প্রায় ৪০ হাজার বর্গমিটার জুড়ে যা ছড়িয়ে ছিল। কার্বন ডেটিংয়ে তলিয়ে যাওয়া গ্রামটিকে নয় হাজার বছরের প্রাচীন বলে দাবি করে গবেষকের দল। সেখানে ছোট পাথরের বাড়ি, পাঁচ মিটার গভীর কুয়ো এবং মানব কঙ্কালের হদিস মিলেছিল। একই রকমের হারিয়ে যাওয়া জলমগ্ন শহর পাওয়া গেছে গুজরাট উপকূলে। যা মহাভারতের নায়ক শ্রীকৃষ্ণর দ্বারকা নগরী বলে বিশ্বাস করেন অনেকে। জলের ১২ মিটার গভীরে থাকা ওই নগরটির বয়স ১২ হাজার বছর বলে কার্বন ডেটিংয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে যার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন ডুবুরিরা।

এই আবহে ইয়োনাগুনির জলমগ্ন শহরের আবিষ্কার সারা বিশ্বে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই সময়কার ভূ-বিজ্ঞানীরা বলতে শুরু করেন, তুষার যুগ শেষ হওয়ার সময়ে বরফ গলে দিয়ে জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় ওই নগরের জলসমাধি ঘটে। বসে ছিল না টোকিয়োর সরকারও। রহস্যময় পিরামিড শহরের মানচিত্র তৈরিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ‘উদীয়মান সূর্য’র দেশ। জলমগ্ন পিরামিড শহরের মানচিত্র পেতে একাধিক ডুবুরিকে কাজে লাগায় জাপান। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে ডুব দেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও সমুদ্র ভূবিজ্ঞানীরাও। তাদের থেকেই মেলে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, জলমগ্ন শহরটি ৪৫ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। যার ভেতরের পিরামিড আকারের স্থাপত্যটি প্রকৃতপক্ষে একটি দুর্গ। ইয়োনাগুনির জলমগ্ন শহরে মেলে বেশ কিছু লিপির আকারের পাথরের। যার পাঠোদ্ধার অবশ্য করা যায়নি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের দাবি, পিরামিড দুর্গটির মধ্যে রয়েছে অন্তত পাঁচটি মন্দির। এর একটি বড় দরজার হদিস পাওয়া গেছে। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত এই হারিয়ে যাওয়া শহরটি বিশ্বের গবেষকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

জাপানি গবেষক মাসাকি কিমুরার দাবি, জলমগ্ন পিরামিড শহরটি অন্তত ১০ হাজার বছরের প্রাচীন। তুষার যুগের একেবারে শেষ পর্যন্ত যা টিঁকে ছিল। ওই সময়ে বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রের জলস্তরে বৃদ্ধি পায়। যার জেরে এটি ধ্বংস হয়েছিল। কিমুরার কথা সত্যি হলে, জাপানের হারিয়ে যাওয়া ওই পিরামিড শহর সিন্ধু ও মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে প্রাচীন। জলমগ্ন শহরের শুধু প্রাচীনত্ব বলেই কিমুরা থেমে থাকেননি। তিনি একে হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ ‘এমইউ’র অংশ বলে দাবি করে বসেন। অষ্টাদশ শতক থেকে যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে চর্চা চলছিল। এই মহাদেশের কথা প্রথম বলেন অগাস্টাস লে প্লনজিয়ন নামের এক প্রত্নতত্ত্ববিদ। প্রাচীন মায়া সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার করে ছিলেন তিনি।

অগাস্টাসের লেখায় এমইউ নামের একটি মহাদেশের উল্লেখ রয়েছে। মায়া সভ্যতার বাসিন্দারা নাকি এর কথা জানতেন। পরবর্তীকালে তার এই তত্ত্বকে সমর্থন জানান বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ও ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ। তাদের দাবি, এমইউ মহাদেশটি আকারে ছিল দক্ষিণ আমেরিকার চেয়ে বড়। সেখানে ১০ প্রজাতির মোট ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করতেন। ভূ-বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, একটা সময়ে প্রবল ভূমিকম্পের জেরে ওই মহাদেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল অগ্নুৎপাত। পাশাপাশি, গোটা এলাকা মাটির নিচে বসে যেতে শুরু করে। শেষে ৯ হাজার ৫৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তা পুরোপুরি প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় চলে যায়। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর পূর্বে ঘটে ওই ঘটনা। কিন্তু পরবর্তীকালে এই তত্ত্ব মানতে চাননি সমুদ্র গবেষকেরা। তাদের যুক্তি, প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের মানচিত্র কৃত্রিম উপগ্রহের অতি শক্তিশালী ক্যামেরায় তোলা ছবির ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে এই ধরনের হারিয়ে যাওয়া কোনো মহাদেশের চিহ্ন বা অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই অবস্থায় ১৯৯৭ সালে রহস্য সমাধানে উদ্যোগী হন জাপানি শিল্পপতি ইয়াসুও ওয়াতানবে। ডুবে থাকা পিরামিড শহরে বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়ে হাজির হন তিনি। যাতে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ জন অ্যানাথনি ওয়েস্ট ও গ্রাহাম হ্যানকক, চিত্রগ্রাহক সান্থা ফিয়া এবং ‘ডিসকভারি’ চ্যানেলের বিশেষ দলের সদস্যেরা। এই গবেষক দল সমুদ্রের গভীরে গিয়ে পিরামিড শহরের প্রতিটা কোনা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। পরে তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে দাবি করা হয়, হারিয়ে যাওয়া শহরটি মনুষ্য সৃষ্ট নয়। এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এটি কোনো পিরামিড শহর নয়। বরং একটি ডুবে থাকা পাহাড়। যা আখছাড় প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা যায়।

ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, যাকে পিরামিড শহর বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেখানে কোনো প্রকোষ্ঠের হদিস পাওয়া যায়নি। এটি মূলত বেলে ও মেটে পাথর দিয়ে তৈরি। যে কোনো স্থাপত্য নির্মাণের জন্য পাথরকে ছোট ছোট করে কাটতে হয়। যার কোনো অস্তিত্ব সেখানে দেখা যায়নি। ওয়েস্ট ও হ্যানককের অনুমান, সমুদ্রের গভীরে বিশেষ একটি জায়গা থেকে ওই পাহাড়ের ছবি তোলা হয়েছে। যার জেরে একে পিরামিড শহর বলে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ এলাকায় অবস্থিত। যেখানে প্লেটের অহরহ ঘর্ষণ চলছে। ফলে জলমগ্ন পাহাড়ের কোনো একটা অংশ নিখুঁতভাবে কেটে গিয়ে একপাশে সরে যাওয়া আশ্চর্যের নয়। যদিও আধুনিক এই তত্ত্ব বিশ্ব জুড়ে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেন ইয়োনাগুনিতে রয়েছে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন জলমগ্ন পিরামিড শহর। যা দেখতে এখনও দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পর্যটক ভিড় জমান উদীয়মান সূর্যের দেশটির ওই দ্বীপে।

 

ভোরের আকাশ/রন