ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত দুইজন উপদেষ্টাকে নিয়ে বির্তক ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতারাসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নেতাদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা করতে দেখা গেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। নতুন নিয়োগ পাওয়া তিনজনের মধ্যে দুইজনকে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বলেও আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কার স্বার্থে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
এদিকে জুলাই আন্দোলনে অবদান নেই বা পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরদের উপদেষ্টা নিয়োগের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ছাত্রদের রক্তের ওপর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আর অন্য সমন্বয়করা প্রয়োজনে ফের রাস্তায় নামার হুমকি দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিন দফা উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফা গত ৮ অগাস্ট ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৬ আগস্ট উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন আলী ইমাম মজুমদারসহ চারজন। সর্বশেষ গত রোববার (১০ নভেম্বর) আরও তিনজন শপথ নেওয়ায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এখন ২৪। গত রোববার (১০ নভেম্বর) শপথ নেওয়া সেখ বশিরউদ্দীনকে বাণিজ্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পেয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আর প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করা মাহফুজ আলমকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হলেও এখনো তাকে কোনো মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়নি।
নতুন উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নাম প্রচারের পর রোববার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ঝড় উঠে। সেখ বশিরউদ্দীন শিল্পপতি শেখ আকিজ উদ্দীনের সন্তান। তাকে নিয়ে বিতর্ক উঠে তিনি আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী ও তার নামে জুলাই আন্দোলনে ছাত্রহত্যার মামলা রয়েছে মাগুরায়। এ ছাড়া তার ভাই শেখ আফিল উদ্দীন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ছিলেন।
অন্যদিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে বলা হচ্ছে, তিনি গণজাগরণ মঞ্চের কট্টোর সমর্থক। তিনি সে সময় এক পোস্টে শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণদের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের দুদিন পর ৭ আগস্ট তিনি আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি সংস্কারের তাগিদ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তিনি লিখেছিলেন ‘আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা জরুরি কাজ হবে ৩২ নম্বরের বাড়ির সংস্কার কাজ শুরু করা। এই বাড়িকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং এ বাড়ি সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি, স্মৃতিস্মারক যা যা পাওয়া যায় তা দিয়ে যাদুঘর আবার চালু করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ইউনূসের উচিত হবে নিজেই বাড়িটা ভিজিট করা। তিনি এই বাড়ি ভিজিট করলে একটা সিগনিফিকেন্স তৈরি হবে, একটা বার্তা দেবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। এগুলো সব ঠিকঠাক করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মন্দির থাকবে, মসজিদ থাকবে, প্যাগোডা থাকবে, গির্জা থাকবে, বোরকা থাকবে, জিনস থাকবে। সবকিছুই থাকবে বহুজনের এই সমাজে।’ এ ছাড়া তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুশরাত ইমরোজ তিশা মুজিব চলচ্চিত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
এই নিয়োগের পর উপদেষ্টা নিয়োগে কার পরামর্শ নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্ন তোলেন খোদ জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া একই বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা নিয়োগেরও ব্যাপক সমালোচনা উঠে। রাতেই মশাল মিছিল করেন ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আর গতকাল সোমবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিপ্লবের চেতনা নিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদে ফ্যাসিবাদী দোসরদের স্থান দিয়ে শহীদের রক্তের অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদ হিসেবে এই মানববন্ধন করা হয়। সেখানে ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, এভাবে ফ্যাসিবাদীর দোসরদের উপদেষ্টা নিয়োগের মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের রক্তের ওপর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন হচ্ছে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিরাপত্তা দিতে শিক্ষার্থীরা বারবার রাস্তায় নামবে না। নতুন যাদেরকে উপদেষ্টা বানানো হয়েছে দেশের জন্য তাদের অবদান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
মানববন্ধনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, আমরা একদফা দাবি আদায়ে বলেছিলাম, ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলা চাই। এই বাংলা থেকে ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের দোসরদেরও উচ্ছেদ করতে হবে। ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে আমরা আবারও রাস্তায় নামতে বাধ্য হবো।
প্রতিবাদ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, যাদের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ছিল না, তারা কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জায়গা পেয়েছে। এই লোকগুলো জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিতে গণভবনে ছিল। শিক্ষার্থীদের দাবি, ২৪-এর আন্দোলনের সঙ্গে যারা ছিল না তারা সরকারে থাকতে পারবে না। এই সরকারে আওয়ামী লীগের কোনো দোসর থাকতে পারবে না।
এর আগে রোববার রাতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুক পাতায় লেখেন ‘শুধু একটা বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই! তার ওপর খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে! এই আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ লিখেছেন ‘যে কারো বিরোধিতা করতে আমি দ্বিধা করবো না এবং এ বিরোধিতা ন্যায্য ও দায়িত্বও বটে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী ঘরানার লোকজন উপদেষ্টা পরিষদে ঢুকে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনিও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া আরেক অনুষ্ঠানে নতুন উপদেষ্টাদের নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন দলটির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
গতকাল সোমবার (১১ নভেম্বর) প্রথম দিন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, আন্দোলনকারীদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমার ধারণা, কেউ কেউ ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তার নামে মামলা আছে কিনা প্রশ্নের জবাব তিনি বলেছেন, বিষয়টি আমি শোনার পর যাচাইয়ের চেষ্টা করছি। আর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সাংবাদিকদের বলেছেন- শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হলে তিনিও জেলে থাকতেন। তিনি দাবি করেছেন ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে সরকারের পতনের জন্য সক্রিয় ছিলেন তিনি।
ভোরের আকাশ/রন