বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পট পরিবর্তন হলো ৫ নভেম্বর। সারাবিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চার বছর আগে তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে যান। আগামী ২০ জানুয়ারি শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে ফের তিনি ফিরছেন হোয়াইট হাউসে; অর্থাৎ তার প্রত্যাবর্তন হচ্ছে। এ নিয়ে মার্কিনিদের; বিশেষ করে রিপাবলিকানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকছে। উচ্ছ্বাস কাজ করছে আমার মধ্যেও। আবার শঙ্কাও কাজ করছে। উচ্ছ্বাস কাজ করছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- ট্রাম্পের একটি প্রতিশ্রুতি। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধ শুরু করব না; সব যুদ্ধ থামিয়ে দেব’। আমি তার এই কথার ওপর ভরসা রাখতে চাই। তিনি যেন সব যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। বিশ্বে যেন শান্তি ফিরে আসে। তিনি যে যুদ্ধ থামাতে পারবেন; তা আমি বিশ্বাস করি। কেন বিশ্বাস করি; তা বোঝার জন্য ১০ বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে। ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় ছিলেন চার বছর। এই সময়ে তিনি কোনো যুদ্ধে জড়াননি। বরং তিনি যুদ্ধংদেহী উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। সিঙ্গাপুরে এই আলোচনা হয়েছিল। পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে তিনি তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তাতে সায় দিয়েছিলেন কিম। তিনি পরমাণু অস্ত্র তৈরির বেশ কিছু স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেন। তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম- উত্তর কোরিয়া শান্তির পথে এগোল। কিন্তু পরবর্তীতে সেখান থেকে কিম কেন মুখ ফিরিয়ে নিলেন; তা সবারই জানা। আরেক যুদ্ধংদেহী ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসিয়েছিলেন ট্রাম্প। তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না- ইরানের সঙ্গে এমন চুক্তি করেছিলেন তিনি। সেই চুক্তি ইরান মেনে চলেছিল। পরে ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যান। ক্ষমতায় আসেন ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা জো-বাইডেন। তিনি সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন। বাইডেনের শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্য বোমায় ক্ষতবিক্ষত। ফিলিস্তিনের গাজায় প্রতিনিয়ত মানুষ মারছে ইসরায়েল। পুরো গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ। এরই মধ্যে ৪২ হাজরের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের একটা বড় অংশ নারী ও শিশু। সেখানে মানবিক বিপর্যয় চলছে। খাবার নেই, আশ্রয় নেই, বাসস্থান নেই, যখন তখন পড়ছে বোমা ও গুলো। এক মিনিটের নিশ্চয়তা নেই সেখানে। এতো গেল গাজার অবস্থা। কিছুদিন ধরে লেবাননে টানা হামলা করছে ইসরায়েল। সেখানেও কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপ। উভয় দেশেই চলছে মানবিক বিপর্যয়। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর মার্কিন নেতৃত্বে হামলা চলছে। সিরিয়া ও ইরাকে ইরানপন্থিদের ওপর মার্কিন হামলা চলছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়; যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপেও। বছর তিনেক ধরে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে। মূলত এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকা। ইসরায়েল ও ইউক্রেনে সমানতালে যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহ করছে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা। ফলে এই যুদ্ধ কখন শেষ হবে; তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। ট্রাম্প যদি এই যুদ্ধ থামিয়ে দেন; তাহলে মানবতার বড় জয় হবে। তবে ট্রাম্প যে যুদ্ধ থামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; সেটা বলা যায় বৈকি। সেই ইঙ্গিত মিলেছে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কথায়। তিনি গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজধানী রিয়াদে আরব ও মুসলিম নেতাদের সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। ফিলিস্তিন ও লেবাননের জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করেন তিনি। সৌদি যুবরাজ ইসরায়েলকে যেকোনো ধরনের আগ্রাসন থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন এবং বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রিয়াদে আরব লিগ ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলন সোমবার শুরু হয়েছে। এ সম্মেলনে আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইতও ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণের দুর্দশা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বিশ্বকে এ সহিংসতা দেখেও চোখ বুজে থাকতে দেওয়া যায় না। ইসরায়েলের পদক্ষেপ স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যাহত করছে। কেবল ন্যায়বিচারেই এ শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
রিয়াদে আরব লীগ এবং ওআইসির একইরকম একটি সম্মেলনের এক বছর পর আবার এই সম্মেলন হচ্ছে। একবছর আগের সম্মেলনেও সম্মেলনের নেতারা গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে ‘বর্বরোচিত’ বলে নিন্দা করেছিলেন। তবে নেতারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে একমত হতে পারেননি। যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তেল সরবরাহ ব্যাহত করার ডাক এসেছিল। এবার যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের আরেক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চলার সময়ে এই সম্মেলন হচ্ছে। আগের মেয়াদে ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রনীতির নাম দিয়েছিলেন ‘আমেরিকা আগে’ নীতি। তিনি ন্যাটো থেকে আমেরিকাকে বের করে নিতে পারেন। আর সেটা না করলে তিনি ন্যাটোর খরচ কমাবেন- এটা নিশ্চিত। ফলে যুদ্ধের অবসান ঘটতে পারে- এমনটা ধরে নেওয়া যায়। তবে তিনি কী সত্যিই সেটা পারবেন; সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/রন