দেশের স্কুলে ভর্তি যুদ্ধের পাশাপাশি শুরু হয়েছে সন্তানের জন্ম সনদ সংগ্রহে ভোগান্তি। ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে গিয়ে এই জন্ম সনদ সংগ্রহে ভিড় জমিয়ে তুলেছেন অভিভাবকরা। গত কয়েকদিন যাবৎ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে বেশ ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভিভাবকরা সন্তানের জন্ম সনদ করাতেই তারা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কারণ, বর্তমানে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে গেলে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এছাড়া নতুন পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, সরকারি-বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকায় নাম তোলা, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ প্রায় ১৮ রকম নাগরিক সেবায় জন্ম সনদ জন্ম সনদ জরুরি হয়ে পড়েছে। গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে এইমর্মে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সারাদেশে শুরু হয়েছে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ। আর সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে জন্ম সনদ বাধ্যতমূলক করা হয়েছে। তবে অভিভাবকদের অভিযোগ, আগে বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো যেত। কিন্তু অভিভাবকদের জন্ম সনদের বিধান পরিস্থিতিকে অহেতুক জটিল করে তুলেছে। এতে যতটা না ভালো হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ফলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তারা বলছেন, এখন যারা অভিভাবক তাদের জন্মের সময়ে জন্ম সনদ নেওয়ার চর্চাই ছিল না। পরিণত বয়সে এসে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য সনদের কাগজ করিয়ে নেওয়ার মানে নেই। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, বংশানুক্রম নির্ধারণের চিন্তা এবং পারিবারিক ধারাবাহিকতা মেলাতে আওয়ামী লীগ সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিল। সম্পদের উত্তরাধিকার যেন সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আমরা জানি, একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, মা-বাবার নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত রেজিস্টারে লেখা বা নিবন্ধিত করাই হচ্ছে জন্ম নিবন্ধন। জন্ম নিবন্ধন করা সবার জন্যই জরুরি। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। যদি না করা হয় তাহলে পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পাসপোর্ট করা, সরকারি, বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা করা, জমি রেজিস্ট্রি, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স, গ্যাস, পানি, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন বা টিআইএন নম্বর, বাড়ির নকশা অনুমোদন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন।
অবিভক্ত বাংলায় প্রথম জন্ম নিবন্ধন আইন প্রবর্তন করে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৩ সালের ২ জুলাই। ১১৮ বছর আগে আইনটি চালু হওয়ার পর দেশটির ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও আইনি পরিবর্তন হলেও সব জনগোষ্ঠী জন্ম নিবন্ধকরণের আওতায় আসেনি। তাই ২০০১ সালে স্থানীয় সরকারের অধীনে ইউনিসেফের অর্থায়নে ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকরণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের অংশ হিসেবে একদিকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকরণ আইন ২০০৪ (২০০৪ সালের ২৯নং আইন) প্রবর্তন করে অন্যদিকে ১৮৭৩ সালে করা জন্ম, মৃত্যু নিবন্ধন আইন এবং ১৮৮৬ সালের জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ আইন বাতিল করে সরকার।
২০০৪ সালের ৭ ডিসেম্বর গৃহীত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ আইনটি কার্যকর হয় ২০০৬ সালের ২ জুলাই। নতুন আইন অনুসারে সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নীতিমালা ২০০৬ প্রণয়ন করে। এরপর জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ে বিধিমালা ২০১৮ নামে (মার্চ ৮) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।
আমরা মনে করি, জন্ম নিবন্ধন সনদ এখন দেশের নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ২০০৪ সালের আইনানুসারে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু সঠিক নিয়ম না জানান কারণে এই জন্মসনদ সংগ্রহে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আমরা চাই , সন্তানদের জন্ম সনদ সংগ্রহে এই ভোগান্তির নিরসন হোক। অভিভাবকরা যাতে সহজে সন্তানদের জন্ম সনদ পেতে পারে সরকার সেইলক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন