মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। উপমহাদেশের অন্যতম এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। এ উপলক্ষে ঢাকা ও টাঙ্গাইলের সন্তোষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি ছিলেন এদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত, মেহনতি মানুষের মুক্তির দিশারী। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা আলোচনা ও স্মরণ করার মতো একটি উজ্জ্বল ভূমিকা।
মওলানা ভাসানী ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জের ধনগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজি শরাফত আলী খান। মক্তব থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সঙ্গে আসাম যান। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি সবসময় রাজনীতি করেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে পল্টনে এই ভাষণ দেন। দুই প্রধান নেতার একই সিদ্ধান্তে চলে আসার একটি উদাহরণ স্থাপিত হয়। তবে এ উদাহরণটি ইতিহাসের পাতায় অনেকটাই অনুপস্থিতই বলা যায়। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে যায় ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই, তবে যখন প্রধান দুই নেতা একসঙ্গে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রকাশ করেন তখন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ঠিক এমনটিই ঘটেছিল তখন বাঙালির জীবনে।
’৭১ এর জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী সারাদেশে জনসভা করে জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন । যে কোনো আন্দোলনের জন্য তৃণমূল গঠন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোধহয় রাজনীতিতে সক্রিয় নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বোঝানোর জন্য আলাদা করে কোনো শব্দপ্রয়োগের প্রয়োজন হবে না।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৪ এপ্রিল পাকসেনারা মওলানা ভাসানীকে হত্যা অথবা গ্রেপ্তারের উদ্দেশে সন্তোষে এসে তাকে খুঁজতে থাকে এবং জিজ্ঞেস করে, ‘কাফের ভাসানী কোথায়?’ তাকে না পেয়ে তার বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় । পাক-বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে নানা কৌশলে মওলানা ভাসানী পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে প্রবেশের পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকার কলাম জুড়ে ছাপা হয়, ‘সীমান্তের এপার ভাসানী - সজল চোখে সাহায্য প্রার্থনা’।
যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে অবস্থান করে মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধকে সুদৃঢ় এবং মুক্তিযুদ্ধের গতিবেগ সঞ্চার করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব, মুসলিম বিশ্বের কাছে, গণতান্ত্রিক সকল রাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসীর কাছে চিঠি পাঠান। আর ’৭১ এ চীন ও আমেরিকা বাংলাদেশের বিরোধিতা ও পাকিস্তানকে সমর্থন করায় মওলানা ভাসানী তাদের কৃত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে একের পর এক বিবৃতি প্রদান করে চিঠিপত্র ও টেলিগ্রাম পাঠান এসব দেশে। মওলানা ভাসানী সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এ ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করে বিজয়ের পথে নিয়ে যান।
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তান যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই।’ ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।’
১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ সহ ৫ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠিত হয়, যা ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৮ সদস্য বিশিষ্ট এ পরামর্শক কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। আন্তর্জাতিক শক্তিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে আনতে এ কমিটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের পুরো সময় মওলানা ভাসানী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা রাখতে জাতিসংঘ, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে তারবার্তা প্রেরণের পাশাপাশি তাঁর আন্তর্জাতিক প্রভাবের সর্বাত্মক ব্যবহার করেছিলেন।
সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের মহানায়ক যদি ভাসানী হন তবে স্বার্থহানী হবে ভারতের। কারণ ভাসানী হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করতেন না এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। মাওলানা ভাসানীর মাজারের দুটি প্রবেশদ্বারে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশ কিছু রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করা রয়েছে। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে মাজার প্রাঙ্গনে প্রবেশমাত্রই বাঁ পাশে একটি বটবৃক্ষ লক্ষ্য করা যায়। যেটি ১৯৭৫ সনে নিজ হাতে রোপন করেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী।
উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম রাজনীতিবিদ ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহমান রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি তার কর্মীদের কাছে হুজুর মওলানা ভাসানী নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে মানুষের কাছে মজলুম জননেতা হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনে বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থি কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীরা অনেকে এজন্য তাকে ‘রেড মাওলানা’ নামেও ডাকতেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষকপার্টি করার জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী নেতা। তিনি পঞ্চাশের দশকে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শুরুর দিকে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশেই ছিলেন। তখন তিনি টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। তবে তিনি টাঙ্গাইলে সন্তোষে নিজ বাড়িতে ছিলেন না। নিজ বাড়ি ছেড়ে সেসময় তিনি উঠেছিলেন টাঙ্গাইলে। আরেকটি গ্রামে তার এক অনুসারীর বাড়িতে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন দুইজন বামপন্থি নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘খামোশ’ বলার ব্যক্তি ছিলেন মওলানা ভাসানী। অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বদা ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণ করে সতর্ক করতেন তিনি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে দেশের অনেক রাজনীতিবিদরা মওলানা ভাসানীকে ভুলতে বসেছেন। বিভিন্ন সময় সরকার প্রধানরা এ মহান মানুষটিকে মর্যাদা, সম্মান ও মূল্যায়ন করতে বেমালুম ভুলে গেছেন। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পরে তাহার অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। গুণী মানুষের অবদান বাংলাদেশে খুব কম হয় বলেই স্বাধীনতাকামী এ দেশটির অবস্থা এখন হ য ব র ল।
সুপ্রিয় পাঠক আসুন, মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে দেশের খ্যাতিমান ও সুপরিচিত রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমার এই লেখায় আমি ব্যক্তিগতভাবে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে গভীরভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন