বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গনে ডনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বাণিজ্যযুদ্ধ এক বিস্ময়কর এবং বিতর্কিত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে চায়, অন্যদিকে এই পদক্ষেপ নিজ দেশের জনগণের জন্যও এক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে। এই সিদ্ধান্ত কী সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প পুনর্জাগরণে সহায়ক হবে, নাকি এটি মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের জোয়ারে দেশকে ভাসিয়ে দেবে?
ডনাল্ড ট্রাম্পের আগের শাসনামল এবং এবারের নির্বাচনি ইশতেহার বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, সমরযুদ্ধের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। তার যত চিন্তা বাণিজ্যযুদ্ধকে ঘিরে। হবো ট্রাম্প প্রশাসন আশা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সকল আমদানি দ্রব্যে ১০-২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করবে, চীনের পণ্যে যা হবে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার) এমন মনোভাব চীনসহ পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর জন্য নিশ্চিত মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে রপ্তানিনির্ভর প্রায় সকল দেশকেও নিজ নিজ বাণিজ্য নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
কিন্তু আমার মনে হয় না যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এতটা কঠোর হতে পারবে। যদি হয়, তাহলে বিশ্বের অন্য সকল রাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গে মার্কিন জনগণকেও দ্রব্যমূল্যের উলম্ফন নিয়ে ভুগতে হবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের তা ভালো করে জানার কথা।
গতবার যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন (এটি মূলত একটি অতিরিক্ত বিক্রয় কর), এই নীতির সমর্থকরা আশা করেছিলেন যে, শুল্ক আরোপের কারণে মার্কিন নাগরিকরা বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য কিনতে নিরুৎসাহিত হবে এবং এর পরিবর্তে আরও বেশি নিজেদের দেশে তৈরি পণ্য কিনবে। দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ার ফলে বর্ধিত চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। আর এই বাড়তি উৎপাদনের জন্য তাদের বেশি লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। অর্থাৎ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বেকারত্বের হারও কমে যাবে।
অন্যদিকে, তাদের হিসাব ছিল ছিল রপ্তানি আয় যথারীতি থাকবে। ফলস্বরূপ, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় বেশি হয়ে এটি নিট রপ্তানির উন্নতি করবে এবং নিজ দেশে সামগ্রিক ব্যয়ের (Aggregate Expenditure) বৃদ্ধি ঘটাবে। অর্থনীতির ভাষায় কান টেনে মাথা নাড়ানোর এই বিষয়টিকে ব্যয়ের সংঘাত (Spending Shock) বলে। তাদের আশা ছিল যে, এই ব্যয়ের সংঘাত আইএস কার্ভকে ডান দিকে সরিয়ে দেবে (IS Curve represents the locus where the aggregate expenditure is equal to the real GDP), যা আরও বেশি দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে এবং জিডিপির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে (Increase in Positive Output Gap)।
তবে কথায় আছে না, ‘অতি ভালো ভালো না’। জিডিপির এই অতি বাড়াবাড়ির কারণে (Overheating Economy) মানুষের মধ্যে বেশি বেশি খরচের হাত বেড়ে যায়, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ থাকে না। আর বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। সহজ কথায় এটাই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে মূল্যস্ফীতি কম থাকায় (দুই শতাংশের নীচে) তারা শুল্কারোপের ফলে মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত ছিল না। বলা প্রাসঙ্গিক যে, এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহ সুদ আরোপ করে থাকে যাকে মুদ্রানীতি বলে (Monetary Policy)।
যাইহোক, ট্রাম্পের অর্থনীতিবিদরা যা অনুমান করেননি, তা হলো, চীন ও ইউরোপও তাদের নিজস্ব শুল্কের মাধ্যমে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমাতে ডিজাইন করা হয়েছিল। আমদানি কমার সঙ্গে রপ্তানিও কমলে, নিট রপ্তানিতে বা সামগ্রিক ব্যয়ে কোনো প্রভাব পড়ে না। ইতিবাচক ব্যয়ের শকটি (কম আমদানি) নেতিবাচক ব্যয়ের শক (কম রপ্তানি) দ্বারা অফসেট হয়। ফলে, প্রকৃতপক্ষে তেমন পরিবর্তিত হয়নি, অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের হিসেবে তেমন তারতম্য ঘটেনি।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়াবাড়ি রকমের শুল্ক আরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল; এগুলো একটি নেতিবাচক সরবরাহ শকের (Supply Shock) দিকে নিয়ে গিয়েছিল, যা অপ্রত্যাশিতভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছিল কীভাবে শুনুন।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি পণ্যের অর্ধেকেরও বেশি কাঁচামাল, যা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাক্টরিগুলোর উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। অতিরিক্ত শুল্কারোপ এই আমদানিকৃত উপকরণগুলোর ক্রয় খরচ বাড়িয়ে দেয়। যখন আমদানিকৃত উপকরণের মূল্য বাড়ে, তখন উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পায় এবং ফলস্বরূপ অপ্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় (Phillips Curve ওপরের দিকে সরে যায়)। কারণ, উৎপাদন খরচ বাড়লে কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে, পরবর্তী কয়েক মাসে, যেসব মার্কিন খাত আমদানিকৃত উপকরণের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল, সেগুলো দ্রুত তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে, যা উচ্চতর মূল্যস্ফীতির দিকে পরিচালিত করে।
এইভাবে, ট্রাম্প প্রশাসনের হঠকারী সিদ্ধান্তে একটি ইতিবাচক ব্যয়ের শক (Spending Shock) একটি নেতিবাচক সরবরাহ শকে (Supply Shock) পরিণত হয়েছিল এবং দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে এটি কেবল মূল্যস্ফীতিই বাড়িয়েছিল এবং বেকারত্বের হারও কমেনি। এতে প্রমাণিত হয়, শুধুমাত্র আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো বা বেকারত্বের হার কমানো— কোনোটিই সম্ভব নয়।
তাই ট্রাম্প প্রশাসন আবারও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নাক কেটে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রাভঙ্গ করতে চাইবে এমনটা মনে হয় না! এখন দেখা যাক, ন্যাড়া সেই একই বেলতলায় আবার যায় কিনা?
ভোরের আকাশ/রন