গত দুই দশকে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে গাজীপুর বাংলাদেশের পরিবেশগত অবক্ষয়ের উদাহরণে পরিণত হয়েছে। এ সময় এ এলাকার ৬০% বন উজাড় এবং ৫০% জলাধার দখল করে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সহযোগিতায় রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে ‘গাজীপুর জেলার পরিবেশগত অবস্থা : পরিণতি ও ভ্রমণ’ শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
২০০০ সালে গাজীপুরের বনাঞ্চলের আয়তন ছিল ৩৯,৯৪৩ হেক্টর। ২০২৩ সালে তা কমে ১৬,১৭৪ হেক্টরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ বনাঞ্চল কমেছে ৫৯.৫১%। একই সময় জলাশয়ের আয়তন কমেছে ৫১.৪২%। ২০০০ সালে জলাশয় ছিল ১১,৪৬২ হেক্টর। ২০২৩ সালে সেখান থেকে কমে ৫,৫৬৮ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। মানদণ্ড অনুযায়ী ২০-২৫% বনাঞ্চল এবং ৭-১৪% জলাশয় রাখতে হবে। কিন্তু গাজীপুরে এখন মাত্র ৯.৪৯% বনভূমি এবং ৩.২৭% জলাশয় রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুরে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে এসে বসবাস করছে। এ কারণে শহুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১০.৫১%, যেখানে গ্রামীণ জনসংখ্যা ২.০৫% হ্রাস পেয়েছে। মূলত শিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থানের কারণে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়েছে। এখন কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার ৬১.৫২% বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কর্মরত।
২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শিল্পাঞ্চলের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। শিল্প কারখানার এই বৃদ্ধি বন ও জলাশয় দখলের অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ২০০০ সালে জেলার জমির ২৩.৪৪% বনাঞ্চল, ৬.৭৩% জলাশয়, ৫০.২১% বসতি, ৫.২১% শিল্প এলাকা, ১০.২১% কৃষি এলাকা এবং ৩.১৯% খোলা জায়গা ছিল। ২০২৩ সালের মধ্যে, এসব পরিসংখ্যানে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। এ সময় বসতি এলাকা ৬৫.৮৩% এবং শিল্প অঞ্চলগুলো ৮.৭৩%-এ উন্নীত হয়েছিল। এর বিপরীতে বনাঞ্চলের পরিমাণ কমেছে ৯.৪৯%, জলাশয় ৩.২৭%, কৃষি এলাকা ১১.৯২% এবং উন্মুক্ত স্থান ০.৭৭%। গত দুই দশকে গাজীপুরে অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে প্রায় ২৩,৭৬৯ একর বা ৫৯,৫% বনাঞ্চল বিলীন হয়ে গেছে। গাজীপুরের বাস্তুতন্ত্র ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য নদ-নদী, খাল, জলাভূমি দূষণ ও দখলের কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে। গবেষণায় তুরাগ, লাবান্দা, টঙ্গী, মোগর ও চিলাই নদীসহ প্রধান জলাশয়গুলোতে ২৪৭টি প্রধান স্থান দখল এবং ১৬১টি সক্রিয় দূষণ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। তুরাগ নদী মার্কাস বিল থেকে আসা শিল্পবর্জ্যরে কারণে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। আর লাবন্দা নদী প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ১৫টি পৌরসভার বর্জ্য লাইন এবং ৩৯টি দৃশ্যমান শিল্প বর্জ্য লাইনের কারণে বর্জ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। জবরদখলের কারণে মোগর খালেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং মাটি ভরাটসহ ৩৪টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তুরাগ নদীর তীরে অবৈধ ইটভাটার কারণে দূষণ ও দখল বেড়েছে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। এদিকে, কৃষিকাজ ও মাছ ধরার মতো ঐতিহ্যবাহী জীবিকা ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখোমুখি। গবেষণায় গাজীপুরের পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় পৌর ও জাতীয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আরও অবক্ষয় রোধ করতে এবং জেলার প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য শক্তিশালী পরিবেশগত নীতি এবং তার কার্যকরী প্রয়োগ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভোরের আকাশ/রন