পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে ঋণ ও ধারদেনার টাকা দিয়ে সিলেট সদর উপজেলার এক বাড়ির ১০ যুবক পাড়ি দিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে দেশটির পুলিশ তাদের আটক করে কারাগারে পাঠায়। প্রবাসে কারাবাসে থাকায় বাড়ির লোকজন তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় দেশে অভিভাবকদের দিন কাটছে চরম দুশ্চিন্তায়। কারাগারে থাকা এক বাড়ির ১০ যুবক হলেনÑ সদর উপজেলার কালারুকা গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে এমদাদ হোসেন কামরুল (২২), ভাতিজা আব্দুর শহীদ (২৮), সাব্বির আহমদ (২৩), হানিফ আলী (২৬), ভাগ্নে জাহাঙ্গীর (২৫) ও মিজান আহমদ (২৮), ভাতিজির দিকের নাতি সাহিদ আহমদ (১৮); আব্দুল করিমের আরেক বড়ভাই প্রয়াত আবদুস সাত্তারের তিন ছেলে আবদুর রহমান (৩০), রিয়াজ উল্লাহ (৩২) ও মোহাম্মদ আলী (১৮)। তারা সবাই নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন।
আব্দুল করিম বলেন, আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ঋণের এক লাখ টাকার কিস্তি বাকি। আরও ৭০ হাজার টাকা অন্য দেনা। ছেলে যাওয়ার পর কিছু টাকা পাঠিয়েছিল। এক রুম থেকে ১০ জনকে ধরে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আট মাস ধরে তারা জেলে। আমাদের ছেলেদের জন্য কিছু করেন, আমরা আর এভাবে থাকতে পারছি না। সদর উপজেলার ১ নম্বর জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মানিক মিয়া বলেন, কালারুকা গ্রামের একই বাড়ির ১০ যুবক সৌদি আরবের জেলে রয়েছেন বলে তাদের পরিবার জানিয়েছে। তারা ধারদেনা করে সৌদিতে গিয়েছিলেন। আট মাস ধরে জেলে থাকার কারণে পরিবারগুলো সমস্যায় পড়েছে।
বিষয়টি জানতে পেরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোশ নূর রুবাইয়াৎ গত শুক্রবার দুপুরে ১০ যুবকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। ইউএনও বলেন, পজলে থাকা প্রবাসীদের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে প্রশাসনে পক্ষ থেকে। শুধু এই ১০ জন নয়, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ও প্রবাসীরা জানিয়েছেন, অন্তত ৯৩ বাংলাদেশি এই কারণে কারাবাস করছেন বলে তথ্য পেয়েছে। কারাগারে থাকা ওই বাংলাদেশিরা যাতে সৌদি সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় রেহাই পান, সেই চেষ্টা করার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
স্বজনরা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের প্রবাসীদের মধ্যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে ঝামেলার ফলে সৌদি আরবের হারা এলাকায় গত এপ্রিলে মিছিল করেন একদল বাংলাদেশি। সৌদি আইনে এভাবে মিছিল করার সুযোগ নেই। সে কারণে ১০ এপ্রিল রাতে সৌদি পুলিশ অনেককে আটক করে। এরপর থেকেই তারা জেলে রয়েছেন। সৌদি আরবে থাকা সিলেট সদর উপজেলার এক যুবক, যিনি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তিনি বলেন, আসলে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এক লোকের সঙ্গে হবিগঞ্জের একজনের ঝামেলা হয়েছিল। সেই ঝামেলা বড় হয়ে সৌদিতে মিছিল হয়। সেই মিছিলের ভিডিও টিকটকে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে গ্রেপ্তার করা শুরু করে সৌদি পুলিশ। এ ঘটনায় অন্তত ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জন সিলেটি। বাকিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অন্য জেলার। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। আটক অনেকে কিস্তি ও ধারদেনা করে সৌদিতে এসেছেন।
জেলে থাকা প্রবাসীদের মুক্তির আকুতি জানিয়ে ওই যুবক শুক্রবার বলেন, পারলে কিছু একটা করেন। এভাবে চললে তারা কবে মুক্তি পাবে ঠিক নাই। সরকারের উচিত দ্রুত প্রবাসীদের মুক্তির ব্যবস্থা করা। না হয় তাদের সারাজীবন জেলে থাকতে হবে। প্রবাসীদের সহযোগিতা করুন ভাই; প্রবাসীদের বাঁচান। প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন সৌদি আরবে থাকা আরেকজন বাংলাদেশি। তিনিও ৯৩ জনেরও কারাগারে থাকার কথা বলেছেন। তবে আলাপকালে তারা আইনগত কারণে নিজেদের নাম প্রকাশ করার অনুরোধ জানান। সিলেট সদর উপজেলার কালারুকার ইসলামগঞ্জ বাজারের বাসিন্দা তেরাবুন নেছার তিন ছেলে সৌদি আরবে থাকেন। এখন তিন ছেলেই সৌদি কারাগারে। ছেলেদের মুক্তির জন্য নানাজনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন এই মা।
১৭ সেপ্টেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অ্যান্ড কল্যাণের মহাপরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন তেরাবুন নেছা। আবেদনের একটি কপি দেখেছে। আবেদনে তেরাবুন নেছা বলেন, আমি একজন অসহায় মা। স্বামীহারা বিধবা মহিলা। জীবনে অর্জিত সকল সম্পত্তি বিক্রি ও ঋণ করে জীবিকার তাগিদে আমার অতি আদরের ৩ সন্তানকে সৌদি আরবে কাজের উদ্দেশে পাঠাই। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল রাত ৩টায় ঘুমন্ত অবস্থায় হারা নামক স্থানের একটি তিন তলা বিল্ডিং থেকে সে দেশের পুলিশ তাদের আটক করেছে। রিয়াদের হারা এলাকার আশপাশে মিছিল হয়েছিল, সেই মিছিলের ভিডিও টিকটিকে প্রচার করেন কোনো এক প্রবাসী। কিন্তু আমার ছেলেরা নির্দোষ। মিছিলে অংশ নেওয়ার ভিডিওতে তাদের অস্তিত্ব মেলেনি। একজন অসহায় মা হিসেবে বিনীত অনুরোধ, তদন্ত করে আমার ছেলেদের অতি দ্রুত মুক্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণে সদয় মর্জি কামনা করি।
তিন ছেলের চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেওয়া তেরাবুন বেগম (৫০) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলেদের রাত ৩টার সময় রুম থেকে ধরে নিয়েছে। আমার ছেলেরা দোষী না। আমার ৭ লাখ টাকা ধারদেনা রয়েছে। এখন দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে, আর জেলে থাকা ছেলেদের চিন্তায়। আমরা ছেলেদের মুক্তির জন্য সহযোগিতার আবেদন করার পরও সরকারের কাছ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। এখন কী হবে তাও বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, দেশের কারাগারে থাকলে খোঁজ মিলত, দেখা করতে পারতাম। বিদেশের কারাগারে কোনো অবস্থায় আছে, সেটি আমরা জানি না। ছেলেদের জেলে রেখে খাবার খেতে পারছি না, না পারছি ঘুমাতে। আমার ছেলেদের জন্য কিছু একটা করুন। আমার ছেলেদের মুক্তির জন্য সরকারের সহযোগিতা চাই। তেরাবুন নেছার আবেদন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন তার ভাই ফখর উদ্দিন। তিনি বলছিলেন, তার বোনের স্বামী আবদুস সাত্তার প্রায় তিন বছর আগে মারা গেছেন। প্রথমে বড় ছেলে আবদুর রহমান সৌদি আরব যান। তারপর অন্য ছেলে রিয়াজ উল্লাহ ও মোহাম্মদ আলীকে সৌদিতে নিয়ে যান আবদুর রহমান।
সেখানে তারা রাজমিস্ত্রিসহ নানা কাজ করতেন। তিনজন একসঙ্গে সৌদির রিয়াদের হারা এলাকায় থাকতেন। তিন ছেলে প্রবাসে যাওয়ার পর তাদের আয়ের ওপরই নির্ভরশীল ছিল তেরাবুন নেছার সংসার। ফখর উদ্দিন বলেন, তেরাবুন নেছার এক ছেলে দেশে থাকলেও সে তেমন আয়-রোজগার করতে পারে না। এ অবস্থায় পরিবারটির দিন কাটছে চরম দুশ্চিন্তায়। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দইলগ্রামের মো. জালাল উদ্দিন ও জরিনা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে মো. নাইমুল ইসলাম (২২) এখন সৌদি আরবের কারাগারে বন্দি। জরিনা বেগম বলছিলেন, ঘর চালানোর কেউ নাই, আমার বাচ্চার কোনো দোষ করে নাই। ঈদের দিন ঘুরতে বের হয়েছিল, তখন ধরে নিয়ে গেছে সৌদি পুলিশ। পরে তাকে মিছিলে থাকা লোকদের ছবি দেখিয়ে বলেছে তাদের চিনে কি-না; সে তাদের চিনে না বলে জানায়। তারপর থেকেই আমার ছেলেকে জেলে রাখছে। কাঁদতে কাঁদতে মধ্যবয়সী এই নারী বলেন, বাবা গো, আমাদের পরিবার চালানোর কেউ নাই। আমার ছেলের জন্য কিছু করেন, সারা জীবন মনে রাখমু। আমার একটা ছেলে। তাকে ধারদেনা করে পাঠিয়েছিলাম, ২১ সালের জানুয়ারিতে গিয়েছিল। সে গিয়ে রুজি করছিল, তার পাঠানো টাকা দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। বর্তমানে ধারদেনা করে চলছি। সৌদি আরবে ঈদের দিন রাতে ধরা পড়েছিল। আমার একটা ছেলে বাবা। আমি ভিক্ষা চাই আমার ছেলেকে। কিছু একটা করেন।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর এলাকার বহর গ্রামের ইকবাল হোসেন আহাদ বলেন, আমার ছোট দুই ভাই সৌদি আরবের জেলে। সাত মাসের উপরে তারা জেলে রয়েছে। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনি জানান, ছোট ভাই শাহরিয়ার হোসেনকে ২০২১ সালে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। সে গিয়ে আয় রোজগারও শুরু করেছিলেন। আর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরেক ছোট ভাই কাওসার হোসেনকে ধারদেনা করে সৌদি আরবে পাঠান। এপ্রিল মাসে রাত ৩টার দিকে ঘর থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এতদিন ধরে তারা জেলে থাকায় আমাদের এখানে অনেক ধারদেনা হয়েছে। পরিবার চালাতে গিয়ে আমাদের দেউলিয়া অবস্থা। বহর গ্রামের আরও চারজন একইভাবে কারাগারে আছেন। তারা হলেন- মাসুক চৌধুরীর দুই ছেলে ওহিন চৌধুরী ও মহিম চৌধুরী; হারুনুর রশিদের ছেলে আপ্তাব আহমদ এবং আহমদ আলীর ছেলে ছায়েফ আহমদ। তাদের এক ঘর থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। শাহরিয়ার আর কাওসারের মা জয়গুন নেছা বলেন, আমার দুটি ছেলে জেলে রে বাবা। আমার মনে শান্তি নাই। ছেলেদের মুক্তি চাই।
সিলেটের বিশ্বনাথের মো. আমিন জানান, তার বোনজামাই সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছাত্তার মিয়াও সৌদি আরবের জেলে রয়েছেন। আমার বোনের তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী মানুষটা জেলে। আমরা শুনেছি প্রায় ৯৩ জন সৌদির জেলে রয়েছেন। নভেম্বরের প্রথম দিকে সৌদি আরবের কারাগারে থাকা প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা সিলেট সদরের শিবেরবাজারে একটি বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে সুনামগঞ্জের ছাতক, হবিগঞ্জ ও সিলেটের লোকজনও ছিলেন। সন্তানদের মুক্তির জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এ নিয়ে আলোচনা করেন তারা।
এদিকে সদর উপজেলার কালারুকা গ্রামের বাসিন্দারাও বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। শুক্রবার তাদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তবে তা হয়নি। ওই গ্রামের বাসিন্দা এম রহমান ফারুক বলেন, আমাদের গ্রামের একই পরিবারের ১০ জন ছাড়া সিলেটের আরও প্রবাসী সৌদির কারাগারে রয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা সদরের প্রবাসী পরিবারের সদস্যের বলেছি বড় করে সাংবাদ সম্মেলন ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমরা এলাকাবাসীও তাদের সঙ্গে রয়েছি। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম কল্যাণ) মোহাম্মদ রেজা-ই-রাব্বী বলেন, দূতাবাস থেকে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়েছে, যেন সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। সেটা হলে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনাধীন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
ভোরের আকাশ/রন